১৭৯৯ থেকে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নেপোলিয়ন ছিলেন ইউরোপের ভাগ্যনিয়ন্তা। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে একসময় তাঁরও পতন ঘটে। ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে টিলসিটের সন্ধি স্বাক্ষরের পর থেকেই নেপোলিয়নের পতন ক্রমশ ঘনিয়ে আসে।
|
নেপোলিয়নের পতনের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করো |
নেপোলিয়নের পতনের কারণ
১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসলির কাছে ওয়াটারলু-এর যুদ্ধে তাঁর চূড়ান্ত পরাজয় ও পতন ঘটে। তাঁর পতনের বিভিন্ন কারণ ছিল-
[1] সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা: নেপোলিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল সীমাহীন। তিনি নিজেকে অপরাজেয় বলে মনে করতেন এবং তাঁর সামরিক বাহিনীর কার্যকারিতা সম্পর্কে সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। তার ফলে তিনি ইউরোপের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অন্ধ হয়ে একই সঙ্গে বিভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
[2] সাম্রাজ্যের দুর্বল ভিত্তি: নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল দুর্বল। সামরিক শক্তির জোরে প্রতিষ্ঠিত এই সাম্রাজ্যের প্রতি জনগণের আন্তরিক সমর্থন ছিল না। তিনি যুদ্ধের মাধ্যমে যেসব জাতিকে ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত করেন সেসব জাতি নেপোলিয়ন ও ফরাসি শাসনকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখত।
[3] স্বৈরতন্ত্র: নেপোলিয়ন ইউরোপের জনগণকে বংশানুক্রমিক স্বৈরাচারী শাসকদের হাত থেকে মুক্তির আশ্বাস দিলেও পরবর্তীকালে তিনি নিজেই সেসব দেশে সীমাহীন স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাস্তবে ফ্রান্সকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে ওঠে।
[4] সাম্রাজ্যের বিশালতা: নেপোলিয়নের সুবিশাল সাম্রাজ্যে নিজের কর্তৃত্ব স্থায়ী করার জন্য যে সংগঠন গড়ে তোলা দরকার ছিল সেদিকে নেপোলিয়ন বিশেষ নজর দেননি। ফলে বিশাল সাম্রাজ্যের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ক্রমে শিথিল হয়ে যায় এবং সাম্রাজ্যের বিশালতা তাঁর পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
[5] স্পেনীয় ক্ষত: নেপোলিয়ন স্পেন দখল করে সেখানকার সিংহাসনে নিজের ভাই জোসেফকে বসিয়ে দেন। ফলে স্পেনের জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। এই যুদ্ধে নেপোলিয়নের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে।
[ 6] পোপের সঙ্গে বিরোধ: নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধ কার্যকর করতে গিয়ে রোমের শাসক পোপকে বন্দি করে তাঁর রাজ্য দখল করলে ইউরোপের ক্যাথোলিক ধর্মাবলম্বীরা নেপোলিয়নের ওপর প্রবল ক্ষুব্ধ হয়।
[7] মস্কো অভিযান: রাশিয়া মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা মানতে অস্বীকার করলে নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ (১৮১২ খ্রি.) করেন। সেখানে তাঁর 'মহান সেনাদলের' বেশিরভাগ সৈন্য তীব্র শীত, খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব, মহামারি ও রুশ গেরিলা সৈন্যের আক্রমণে মারা যায়।
[৪] ইংল্যান্ডের নৌশক্তি: ট্রাফালগার ও নীলনদের নৌযুদ্ধে ইংল্যান্ড ফরাসি নৌবহরের যে ক্ষতি করে তা ফ্রান্স আর পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। পরবর্তীকালে স্পেন ও পোর্তুগালের পক্ষে শক্তিশালী ইংল্যান্ড যোগ দিলে নেপোলিয়নের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
[9] মহাদেশীয় অবরোধে ব্যর্থতা: নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ জারি করলেও শক্তিশালী নৌবাহিনীর অভাবে তিনি তা কার্যকরী করতে পারেননি। বলপ্রয়োগ করে অবরোধ কার্যকর করতে গিয়ে তিনি একসঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। অন্যদিকে, নেপোলিয়নের অবরোধের পালটা অস্ত্র হিসেবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড 'অর্ডার্স-ইন-কাউন্সিল' নামে অবরোধ জারি করলে ফ্রান্সের যথেষ্ট ক্ষতি হয়।
[10] শক্তিজোট গঠন: ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া- ইউরোপের এই চারটি বৃহৎ শক্তি নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে শক্তিজোট গঠন করলে তাঁর পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। চতুর্থ শক্তিজোট ওয়াটারলু-এর যুদ্ধে (১৮১৫ খ্রি.) নেপোলিয়নকে পরাজিত করলে তাঁর পতন ঘটে।
মূল্যায়ন: ওয়াটারলু-এর যুদ্ধে পরাজয়ের পর নেপোলিয়নকে সিংহাসনচ্যুত করে ফ্রান্স থেকে প্রায় ৫ হাজার মাইল দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ১৫ মে মাত্র ৫২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।