মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫ খ্রি.)। জার্মানি, ইটালি, জাপান ও তাদের সহযোগী বিভিন্ন দেশকে নিয়ে গঠিত অক্ষশক্তি এবং ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকা ও তাদের সহযোগী বিভিন্ন দেশকে নিয়ে গঠিত মিত্রশক্তির মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির পরাজয় ঘটে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল/প্রভাব
বিভিন্ন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যেমন-
[1] ধ্বংসলীলা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের প্রচুর সামরিক ও অসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়। অন্তত ৫৭ কোটি মানুষ এই যুদ্ধের ফলে প্রাণ হারান। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে নিঃস্ব, রিস্ত অবস্থায় নতুন দেশের ফুটপাতে আশ্রয় নেয়।
[2] যুদ্ধাপরাধের বিচার : বিজয়ী মিত্রপক্ষ পরাজিত অক্ষশক্তির যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তিদানের উদ্যোগ নেয়। ২১ জন নাৎসি আধিকারিককে শান্তি-বিরোধী, মানবতা-বিরোধী ও যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদের ১৪ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং বাকিদের কারাদণ্ড হয়।
[3] ইয়াল্টা সম্মেলন :
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে জার্মানির পরাজয় সুনিশ্চিত হয়ে পড়লে মিত্রপক্ষের আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও রাশিয়া ইয়াল্টা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির দ্বারা-[i] বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠা, [ii] জার্মানি থেকে নাৎসি প্রভাবের অবসান ঘটানো, [iii] জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিদান, [iv] জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় প্রভৃতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
[4] অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন: যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরে 'জাতিপুঞ্জ ত্রাণ ও পুনর্বাসন' বা 'আনরা' প্রতিষ্ঠিত হয়। 'আনরা'র সাহায্যের ফলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশের বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন, কৃষি ও শিল্পের পুনরুজ্জীবন, পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতি সম্ভব হয়।
[5] ট্রুম্যান নীতি: গ্রিস, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ থেকে ব্রিটেন সেনা সরিয়ে নেওয়ার কথা ঘোষণা করলে আমেরিকা আশঙ্কা করে যে, সেসব দেশে কমিউনিস্ট রাশিয়ার আধিপত্য বাড়বে। এই অবস্থায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে ট্রুম্যান নীতি ঘোষণা করেন (১২ মার্চ, ১৯৪৭ খ্রি.)। এই নীতি অনুসারে গ্রিস ও তুরস্কে ৪০ কোটি ডলার সাহায্য দেওয়া হয়।
[6] মার্শাল পরিকল্পনা : মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জর্জ সি মার্শাল 'ইউরোপীয় পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা' ('European Recovery Programme বা 'ERP') নামে এক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এটি সাধারণভাবে 'মার্শাল পরিকল্পনা' নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনার জন্য আমেরিকা চার বছরের জন্য (১৯৪৮-৫১ খ্রি.) ইউরোপের আর্থিক পুনরুজ্জীবন খাতে ১২০০ ডলার অর্থ মঞ্জুর করে।
[7] আমেরিকার আধিপত্য : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে একমাত্র আমেরিকা সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে যুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বিশ্বরাজনীতিতে সক্রিয় হস্তক্ষেপের নীতি গ্রহণ করে।
[৪] জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি: বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন উপনিবেশে
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এশিয়া মহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, বার্মা, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচিন এবং আফ্রিকা মহাদেশের মিশর, সুদান-সহ বিভিন্ন উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
মূল্যায়ন: যুদ্ধশেষে আমেরিকার নেতৃত্বে তার অনুগামীদের নিয়ে 'উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা' বা 'ন্যাটো' (NATO) (১৯৪৯ খ্রি.) নামে জোট গড়ে ওঠে। এর বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে তার অনুগামী রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে 'ওয়ারশ চুক্তি' (১৯৫৫ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়। প্রকাশ্য যুদ্ধ না হলেও উভয় পক্ষের মধ্যে সর্বদা একটি যুদ্ধের পরিবেশ বজায় থাকে। এই ঘটনা 'ঠান্ডা লড়াই' নামে পরিচিত।