ন্যায়দর্শনে ঈশ্বরের ভূমিকা ও স্বরূপ কী তা আলোচনা করো।
- Get link
- X
- Other Apps
ন্যায়দর্শনে ঈশ্বরের ভূমিকা
মহর্ষি গৌতমের ন্যায়সূত্রে ঈশ্বর সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা পরিলক্ষিত না হলেও, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। ন্যায়সূত্রের চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম আহ্নিকে তিনটি সূত্রে ঈশ্বরের উল্লেখ দেখা যায়। বৈশেষিক সূত্রে কিন্তু ঈশ্বর সম্বন্ধে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ করা নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে ন্যায়-বৈশেষিক ভাষ্যকারগণ ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, মোক্ষলাভের নিমিত্ত ঈশ্বরের কৃপা অবশ্যই অপরিহার্য। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, মহর্ষি বাৎস্যায়ন, উদ্যোতকর, উদয়ন, বাচস্পতি মিশ্র, জয়ন্তভট্ট এবং গঙ্গেশোপাধ্যায় প্রমুখ ন্যায় ভাষ্যকারগণ ঈশ্বরের সঙ্গে মোক্ষ বা অপবর্ণের সম্বন্ধ নির্দেশ করেছেন। তাঁরা দাবি করেন যে, ঈশ্বরের করুণা ছাড়া জীব কখনোই তত্ত্বজ্ঞান লাভে সমর্থ নয়। এর ফলে জীব মোক্ষলাভে ব্যর্থ হয়। ফলত ন্যায়দর্শনকে অনেকে নিরীশ্বরবাদীরূপে অভিহিত করলেও, ঈশ্বরবাদের বিষয়টি সেখানে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে।
ন্যায়দর্শনে ঈশ্বরের স্বরূপ
ন্যায়দর্শনে ঈশ্বরের স্বরূপ বা প্রকৃতি হল-
সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের কারণরূপে ঈশ্বর:
ন্যায়দর্শনে যে বারোটি প্রমেয় পদার্থ স্বীকৃত হয়েছে, তাদের মধ্যে আত্মা হল অন্যতম। এই আত্মা দ্বিবিধ-জীবাত্মা এবং পরমাত্মা। ন্যায়দর্শনে পরমাত্মাকেই ঈশ্বররূপে উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যায় মতে, ঈশ্বর হলেন সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ। তিনি জগতের স্রষ্টা, রক্ষক এবং সংহারক। তিনি কিন্তু শুধুই পূর্ণ থেকে জগতের সৃষ্টি করেননি। ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং মরুৎ প্রভৃতি নিত্যপরমাণু, দেশ, কাল, আকাশ, মন এবং আত্মা প্রভৃতির সাহায্যেই ঈশ্বর এই জগৎকে সৃষ্টি করেছেন। এই সমস্ত বিষয়গুলিই হল জগতের উপাদান কারণ। ঈশ্বর কিন্তু জগতের উপাদান কারণ নন। তিনি হলেন নিমিত্ত কারণ। তিনি জগৎ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কর্মফলের বিন্যাসটিকে এমনভাবে সন্নিবেশিত করেছেন যে, এই জগতের প্রত্যেকটি জীবই তার কর্মানুযায়ী ফলভোগ করতে বাধ্য। সুতরাং, ঈশ্বরই হলেন জগতের নিয়ামক। আবার, প্রয়োজন হলে তিনি জগৎ সংহারেরও ব্যবস্থা করেন। তিনি তাই শুধু জগতের স্রষ্টাই নন, সংহারকও বটে। পরমাত্মারূপ ঈশ্বর তাই, একাধারে সৃজনকর্তা, পালনকর্তা এবং অপরদিকে সংহারকর্তাও।
নিত্য, অসীম, এক ও অনন্তরূপে ঈশ্বর:
ন্যায় মতে, ঈশ্বর নিত্য, অসীম, এক ও অনন্ত স্বরূপ। তাঁর সৃষ্ট জগৎ তাই কখনোই তাঁকে সীমায়িত করতে পারে না। এই জগৎ হল ঈশ্বরের দেহস্বরূপ এবং ঈশ্বর হলেন জগতের আত্মাস্বরূপ। আত্মার সঙ্গে জীবদেহের যে সম্পর্ক দেখা যায়, ঈশ্বরের সঙ্গে জগতেরও ঠিক সেইরকম সম্পর্ক দেখা যায়। আবার, ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের সম্পর্ক হল, পিতাপুত্রের সম্পর্কস্বরূপ। পিতা যেমন পুত্রের সামর্থ অনুযায়ী পুত্রকে কর্মে নিযুক্ত করেন এবং তাকে পুরস্কার বা তিরস্কার করেন, ঈশ্বরও তেমনই জীবকে তার ক্ষমতা অনুযায়ী কর্মে নিযুক্ত করেন এবং তাদের পুরস্কার বা তিরস্কার করেন। জীব কর্মের নিমিত্ত মাত্র, ঈশ্বর হলেন সর্বকর্মের প্রযোজক।
জীবের কর্মফলদাতারূপে ঈশ্বর:
ঈশ্বর হলেন জীবের কর্মফলদাতা। জীব তার নিজের ইচ্ছায় কর্ম সম্পাদন করলেও, কর্মফল কিন্তু তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। জীবের কর্মফল নির্ভর করে ঈশ্বরের ওপর। ঈশ্বর জীবের কর্মসমূহের গুণাগুণ বিচার করে কর্মফল প্রদান করেন। ভালো কর্মের জন্য ভালো ফল এবং মন্দ কর্মের জন্য মন্দ ফল প্রদান করে থাকেন। কর্মফল অনুযায়ী জীব তার পাপপুণ্য ভোগ করে, একেই বলা হয় অদৃষ্ট। এই অদৃষ্টের নিয়ন্ত্রক হলেন ঈশ্বর।
ষড়গুণের অধিকারীরূপে ঈশ্বর:
ন্যায় মতে, ঈশ্বর হলেন সর্বজ্ঞ এবং অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী। নিত্য চৈতন্য ঈশ্বরের স্বরূপ নয়, একান্তভাবে তা অপরিহার্য গুণ। তিনি গরিমা, মহিমা প্রভৃতি ষড়ৈশ্বর্যের অধিকারী। ঈশ্বরের ছয়টি সদ্গুণ হল-মহিমা, গরিমা, শক্তিমত্তা, সৌন্দর্য, জ্ঞান এবং স্বাধীনতা। এই ষড়গুণে গুণান্বিত হয়েই ঈশ্বর জগতের প্রধানরূপে গণ্য হন। তিনি তাই জগৎসংসারের নিয়ন্ত্রক ও সর্বোচ্চ সত্তা।
- Get link
- X
- Other Apps