বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তার তুলনা মূলক আলোচনা বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়েই অদ্বৈত বেদান্তের আধুনিক ব্যাখ্যাকর্তারূপে গণ্য। কারণ তারা উভয়েই অদ্বৈতের মূল বিষয়টি অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা বেদান্তের মূল ভাবধারাটিকে নিজের নিজের মতো ব্যাখ্যা করে আমাদের কাছে উপস্থাপিত করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের দার্শনিক চিন্তনের একটি তুলনামূলক আলোচনায় আমরা অগ্রসর হতে পারি।
|
বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথের চিন্তার তুলনামূলক আলোচনা করো। |
বিবেকানন্দের দার্শনিক চিন্তন:
একজন প্রকৃত সন্ন্যাসী হয়েও বিবেকানন্দ তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারার এক মৌলিক ও মননশীল তত্ত্ব আমাদের সামনে হাজির করেছেন। এর ফলে তিনি একজন বিশ্ববন্দিত সন্ন্যাসীরূপে সকলের সমাদর লাভ করেছেন। তিনি কর্মযোগের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার যে ভাবটি আমাদের সামনে হাজির করেছেন, তা সকলেরই অনুকরণীয়। কর্মযোগের মাধ্যমেই বিবেকানন্দ তাঁর দার্শনিক ধ্যানধারণার বিষয়কে মানুষের সামনে উপস্থাপিত করেছেন। কর্মের রহস্য, কর্মের আদর্শ জ্ঞাত হয়ে নিষ্কাম কর্মের মধ্য দিয়ে যে মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা যায়, তা তিনি তাঁর কর্মযোগে ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং বলা যায় যে, কর্মযোগের মাধ্যমেই তাঁর দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। এরূপ চিন্তাধারার মাধ্যমে তিনি সামগ্রিকভাবে মানবজাতির কল্যাণসাধনে ব্রতী হয়েছেন।
বীন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তন:
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত অর্থে শার্শনিক বলা যায় কি না, এ সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন মাখনীর মধ্যে তাঁর দার্শনিক চিন্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। অদ্বৈত বেদান্তের মূলধারা তা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গ্রন্থে। এই সমস্ত মাখনীর মধ্য দিয়ে যে দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিফলিত হয়েছে, তা হল সসীমতার প্রতি পেরিয়ে অসীমতার দিকে এক যাত্রা। মানুষ তার জীবভাবের গণ্ডি হারিয়ে যে বিশ্বভাবে উদ্বুদ্ধ হয় এবং মানবসমাজের সামগ্রিক কল্যাণসাধনে ব্রতী হয়-তা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর 'মানুষের ধর্ম' নামক প্রবন্ধ এবং 'Religion of Man' নামক গ্রন্থে। মানুষের মধ্যে অসীমতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার এই যে ভাব, তাকেই তিনি মানবতাবাদ রূপে উল্লেখ করেছেন। এই মানবতাবাদের মাধ্যমেই তিনি বিশ্বমানবের কল্যাণসাধনে ব্রতী হয়েছেন।
যোগের পথে বিবেকানন্দ, মানবতাবাদের পথে রবীন্দ্রনাথ:
বিবেকানন্দের পথ যোগের, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পথ মানবতাবাদের। বিবেকানন্দ তাঁর কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এবং ধ্যানযোগের মাধ্যমে মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে মানবাত্মার জয়গান গেয়েছেন। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবতাবাদের মাধ্যমে মানুষকে জীবনদেবতার স্তরে উন্নীত করে মানবধর্মের সার্বিক সূত্র গ্রন্থনা করেছেন। এই উভয় প্রচেষ্টাই যেন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতো। কলম্বাস যেমন আমেরিকাকে ইউরোপের চক্ষুগোচর করেছেন, বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথও তেমনই সমাজ, জাতি, দেশ ও ধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষকেই তাঁদের বিশ্বভাবনার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করেছেন।