বিবেকানন্দের বক্তব্যের আলোকে কর্মযোগের অর্থ ও উদ্দেশ্য আলোচনা করো।
- Get link
- X
- Other Apps
বিবেকানন্দের বক্তব্যের আলোকে কর্মযোগের অর্থ
কর্মযোগ শব্দটির শব্দগত বিশ্লেষণ-কর্ম+যোগ= কর্মযোগ। কর্ম শব্দটি সংস্কৃত কৃ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন-যার অর্থ হল কোনো কিছু করা। আর যোগ শব্দের অর্থ হল সুচিন্তিত, সুনিয়ন্ত্রিত ও বিধিবদ্ধ বা বিজ্ঞানসম্মতভাবে কর্ম করা। সুতরাং কর্মযোগ শব্দটির সামগ্রিক অর্থ হল সুনিয়ন্ত্রিত, সুচিন্তিত ও বিধিবদ্ধভাবে কোনো কিছু করা। সুতরাং, কর্মের কৌশল তথা কর্মনৈপুণ্যই হল কর্মযোগ। প্রকৃতপক্ষে সমত্ব চেতনাই হল যোগ শব্দটির প্রকৃত অর্থ। লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় প্রভৃতি সমস্ত কিছুকেই যদি সমান জ্ঞান করে কর্ম করা হয় তাকেই কর্মযোগ বলা হয়। গীতা, উপনিষদ এবং বেদান্ত দর্শনে কর্মযোগের এরূপ ধারণাটিই প্রতিফলিত হয়েছে। বেদান্তের অনুগামী হয়ে বিবেকানন্দও কর্মযোগের এই অর্থ বা ধারণাটিকেই গ্রহণ করেছেন।
বিবেকানন্দের বক্তব্যের আলোকে কর্মযোগের উদ্দেশ্য
বিবেকানন্দের বক্তব্যের আলোকে কর্মযোগের উদ্দেশ্যগুলি হল-
[1] কর্মে আত্মনিয়োগ:
বিবেকানন্দের মতে, প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃগুণ পরিলক্ষিত হয়। আর এই গুণের তারতম্যের জন্যও তাদের কর্ম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরকম হয়। যখন আমাদের মধ্যে তমোগুণ প্রবল হয়ে ওঠে, তখন আমরা আলস্যপরায়ণ ও নিষ্কর্মা হয়ে পড়ি। আবার আমাদের মধ্যে যখন রজঃগুণের প্রাবল্য দেখা যায়, তখন আমরা দারুণভাবে কর্মশীল হয়ে উঠি। আর আমাদের মধ্যে যখন সত্ত্বগুণের আধিক্য লক্ষিত হয়, তখন আমরা সমত্ববুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে ক্রিয়া করি এবং এর ফলে আমাদের মধ্যে একপ্রকার শান্তভাব বিরাজ করে। বিবেকানন্দ দাবি করেন যে, সম্পূর্ণভাবে প্রশান্তি লাভ করতে হলে মানুষকে কর্ম করতেই হবে। আলস্য ত্যাগ করে মানুষকে প্রকৃত অর্থেই কর্মবীর হতে হয়।
2] শারীরিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির জাগরণ:
বিবেকানন্দের মতে, সাধারণ মানুষ তাদের জীবনযাপনের জন্য বিভিন্ন প্রকার কর্ম সম্পাদন করে থাকে। এগুলি মূলত ঐহিক উদ্দেশ্যকে সিদ্ধ করে। এই সমস্ত কর্ম যে তুচ্ছ বা ছোটো তা নয়। কিন্তু তিনি বলেছেন যে, পারত্রিক উদ্দেশ্যে কৃত কর্মই হল শ্রেষ্ঠ। আধ্যাত্মিকতাই আমাদের জীবনে সকলপ্রকার কর্মপ্রচেষ্টার মূলভিত্তি। আধ্যাত্মিক দিক থেকে যিনি সুস্থ ও সবল থাকেন তিনি ইচ্ছা করলে অন্যান্য দিকেও প্রভূত দক্ষ হতে পারেন।
[3] কর্মফলভোগ:
কর্মযোগে বিবেকানন্দ উল্লেখ করেছেন, কর্মের দ্বারাই মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। মনুষ্যকৃত কর্মের ভালোমন্দ, পাপপুণ্য এই উভয় দিকই বিদ্যমান। অর্থাৎ, কর্মের ক্ষেত্রে পরস্পরবিরুদ্ধ দিক পরিলক্ষিত হয়। কর্মনির্ধারিত মানবজীবনে কখনোই কর্মকে এড়িয়ে চলা যায় না। এই কর্মের জন্যই কর্মফলের বিষয়টি উঠে আসে। কর্মফল এক জীবনে সম্ভব না হলেও পরজন্মে সেই ফলভোগ বর্তায়। সেকারণেই মনুষ্যকর্মের সহযোগীর ভূমিকা গ্রহণ করে জন্মান্তরবাদ। জন্মান্তরবাদের ব্যাখ্যায় দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়-প্রথমত ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব খর্ব হয় এবং দ্বিতীয়ত আত্মতত্ত্বের সঞ্জীবন হয়। আত্মতত্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আত্মা চিরন্তন, অমর ও জন্মমৃত্যুরহিত। জন্ম হল আত্মার শরীরধারণ আর মৃত্যু হল আত্মার শরীরমুক্তি। আমাদের সকলপ্রকার কর্মের উৎসই হল শরীর, আবার কর্ম শরীরের মন্ত্র বা ধারকরূপে গণ্য।
[4] আত্মজ্ঞান লাভ:
বিবেকানন্দ বলেন যে, আমাদের সংসারজীবনের কমই হল আধ্যাত্মিক শিক্ষার পাঠশালা। যদি কেবল সাংসারিক লাভের জন্যই কাজ করা হয়, তবে তা আত্মার বন্ধনকেই বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু যদি যথাযথ আত্মজ্ঞানের জন্য কর্ম করা হয়, তাহলে তা অদ্বৈত বেদান্তের মূল কথা-'অহং ব্রহ্মাস্মি' বা 'তত্ত্বমসি'রূপ উপলব্ধির চরম উৎকর্ষতাকেই সূচিত করে। এখানেই স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগের উদ্দেশ্যটি নিহিত।