অলৌকিক সন্নিকর্ষ
ন্যায়দর্শনে প্রত্যক্ষ হল দু-রকম-[1] লৌকিক ও [2] অলৌকিক। লৌকিক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের লৌকিক তথা সরাসরি সন্নিকর্ষ হয়, যেমন চক্ষু নামক ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে ঘটের সন্নিকর্ষ। অপরদিকে, অলৌকিক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের অলৌকিক তথা পরোক্ষ সন্নিকর্ষ সম্পন্ন হয়, যেমন-ঘট প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে চক্ষু নামক ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে ঘটত্ব জাতির প্রত্যক্ষ।
বিভিন্নপ্রকার অলৌকিক সন্নিকর্ষ
ন্যায় মতে, অলৌকিক সন্নিকর্ষ হল তিনপ্রকারー[1] সামান্য লক্ষণ সন্নিকর্ষ, [2] জ্ঞান লক্ষণ সন্নিকর্ষ এবং [3] যোগজ লক্ষণ সন্নিকর্য।
[1] সামান্য লক্ষণ সন্নিকর্ষ: যে প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে বিষয়ের সামান্য ধর্ম তথা জাতিধর্ম সন্নিকর্ষরূপে কাজ করে, তাকেই বলা হয় সামান্য লক্ষণ সন্নিকর্ষ। অর্থাৎ, সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সামান্য জাতি বা সাধারণ ধর্মের সন্নিকর্ষ হয়।
এ ক্ষেত্রে সামান্য জাতি বা সাধারণ ধর্মকে কখনোই সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সে-কারণেই এই ধরনের সন্নিকর্ষ কখনোই লৌকিক বা সরাসরিভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। এই ধরনের সন্নিকর্ষ তাই অলৌকিক তথা পরোক্ষভাবেই সম্পন্ন হয়। সে-কারণেই এই সামান্য লক্ষণ সন্নিকর্ষকে অলৌকিক সন্নিকর্ষরূপেও অভিহিত করা হয়। ঘট প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে যখন ঘটত্ব জাতি বা সামান্য ধর্মের প্রত্যক্ষ হয়, তখন এইপ্রকার সন্নিকর্ষই সংঘটিত হয়।
[2] জ্ঞান লক্ষণ সন্নিকর্ষ: পূর্বজ্ঞানের ভিত্তিতে কোনো বিষয়কে প্রত্যক্ষ
করার ক্ষেত্রে সেই বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের যে অলৌকিক সন্নিকর্ষ সম্পন্ন হয়, তাকেই বলা হয় জ্ঞান লক্ষণ সন্নিকর্ষ। এ ক্ষেত্রে বিষয়ের পূর্বজ্ঞানের স্মৃতিই সন্নিকর্ষের কাজ করে। বিষয়টির জ্ঞান আগে থেকেই আমাদের থাকে বলে, এই ধরনের সন্নিকর্ষকে জ্ঞান লক্ষণ সন্নিকর্ষ বলা হয়। এই ধরনের সন্নিকর্ষ সরাসরিভাবে সম্পন্ন নয়, তা অলৌকিকভাবেই সম্পন্ন। তাই এই জ্ঞান লক্ষণ সন্নিকর্ষকে অলৌকিক সন্নিকর্ষ বলা হয়।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, নাসিকার দ্বারাই আমরা চন্দনকাঠের সুরভি লৌকিক সন্নিকর্ষের মাধ্যমে পাই এবং বলি যে চন্দন সুরভিযুক্ত। চন্দনের সুরভি তাই নাসিকা নামক ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষজনিত বিষয়রূপে গণ্য। কিন্তু চন্দনকাঠ দেখেই বা তাকে চন্দনকাঠ হিসেবে চিনে নিয়ে যখন আমরা পূর্বজ্ঞানের ভিত্তিতে বলি যে, চন্দন সুরভিযুক্ত, তখন সেক্ষেত্রে যে প্রকার সন্নিকর্ষ হয় তাকেই বলা হয় জ্ঞান লক্ষণ সন্নিকর্ষ। এ ক্ষেত্রে চক্ষুর সঙ্গে চন্দনের সুরভির সরাসরি বা লৌকিক সন্নিকর্ষ না হয়ে, অলৌকিকভাবেই সম্পন্ন হয়। সেজন্যই জ্ঞান লক্ষণ সন্নিকর্ষকে অলৌকিক সন্নিকর্ষরূপে গণ্য করা হয়।
[3] যোগজ লক্ষণ সন্নিকর্ষ: যোগসাধনার দ্বারা সিদ্ধপুরুষগণ অলৌকিক শক্তির অধিকারী হন। এর ফলে তাঁরা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ-এই তিনটি কালের সমস্ত বস্তুই প্রত্যক্ষ করতে পারেন। এই ধরনের প্রত্যক্ষ সম্ভব হয় যোগজ সন্নিকর্ষের দ্বারা। যোগজ সন্নিকর্ষের ক্ষেত্রে অতীন্দ্রিয় বিষয়ের প্রত্যক্ষ হয়। এই অতীন্দ্রিয় বিষয়কে কখনোই আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে যে প্রকার সন্নিকর্ষ হয়, তা অলৌকিকভাবে সম্পন্ন। সে- কারণেই যোগজ প্রত্যক্ষকে অলৌকিক সন্নিকর্ষরূপে উল্লেখ করা হয়। যোগীরা অলৌকিক বিষয়সমূহ প্রত্যক্ষ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাই যোগীদের সঙ্গে অলৌকিক বিষয়সমূহের সন্নিকর্ষ অলৌকিকরূপেই গণ্য।