অনুমিতি
অনুমান থেকে উৎপন্ন জ্ঞানকে বলা হয় অনুমিতি। ন্যায় দার্শনিকগণ অনুমিতিকে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের পরই স্বীকার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই অনুমিতির ওপরই ন্যায় সম্প্রদায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। ন্যায় মতে, প্রত্যক্ষলক্স জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে, যদি কোনো অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে পরোক্ষ জ্ঞান লাভ করা যায়, তবে তাকে বলা হয় অনুমিতি। এই অনুমিতি জ্ঞানের করণ তথা প্রমাণকেই বলা হয় অনুমান।
|
অনুমিতি কী? |
শব্দগত অর্থ: অনুমিতি শব্দটির শব্দগত বিশ্লেষণ হল অনু + মিতি =
অনুমিতি। অনু শব্দের অর্থ হল পশ্চাতে বা পরে এবং মিতি শব্দের অর্থ হল জ্ঞান। অর্থাৎ, যে জ্ঞান প্রত্যক্ষের পরে বা পশ্চাতে উৎপন্ন হয়, তাকেই বলা হয় অনুমিতি। যেমন-পর্বতে ধূম প্রত্যক্ষ করে, অনুমান করা হয় যে, সেখানে আগুন আছে। ন্যায়দর্শনের দ্বিতীয় স্বীকৃত প্রমা হল অনুমিতি এবং এর প্রমাণ হল অনুমান।
অনুমিতির ভিত্তি: অনুমিতির লক্ষণ সম্পর্কে আমরা প্রাচীন ন্যায় এবং নব্য ন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি সংজ্ঞা পাই। প্রাচীনপন্থীরা বলেন- পরামর্শজন্যং জ্ঞানম্ অনুমিতিঃ। নব্য নৈয়ায়িকরা বলেন-ব্যাপ্তি জ্ঞান করণকং জ্ঞানম্ অনুমিতিঃ।
প্রাচীন মতে বলা হয়েছে যে, পরামর্শ থেকে উৎপন্ন যে জ্ঞান, তাকেই বলা হয় অনুমান। আর পরামর্শ হল ব্যাপ্তিবিশিষ্ট পক্ষধর্মতার জ্ঞান।
কিন্তু নব্য নৈয়ায়িকদের মতে, পরামর্শ হল ব্যাপ্তি জ্ঞানের ব্যাপার। নব্যরা এই ব্যাপারবিশিষ্ট কারণকেই করণরূপে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা তাই দাবি করেন যে, পরামর্শ ব্যাপ্তি জ্ঞান থেকেই উৎপন্ন হয় এবং অনুমিতির করণরূপে গণ্য হয়। নব্য নৈয়ায়িকরা তাই উল্লেখ করেন যে, যে জ্ঞানের করণ হল ব্যাপ্তি সম্পর্ক বা ব্যাপ্তি জ্ঞান, তাকেই বলা হয় অনুমিতি।
অনুমিতির উপাদান হিসেবে সাধ্য, পক্ষ এবং হেতুর ধারণা
ন্যায়দর্শনে আমরা অনুমিতির উপাদান হিসেবে সাধ্য, পক্ষ এবং হেতু-র ধারণা পেয়ে থাকি। অর্থাৎ, এমন কোনো অনুমিতি গঠন করা যায় না, যেখানে এই তিনটি বিষয় নেই। প্রত্যেক অনুমিতির ক্ষেত্রে এই তিনটি ধারণার গুরুত্ব সমান। এদের যে-কোনোটির গুরুত্বকে তাই কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
সাধ্যর ধারণা: যাকে সিদ্ধ বা প্রমাণ করা হয়, তাকেই বলা হয় সাধ্য।
এই সাধ্যকেই আমরা অনুমানের সিদ্ধান্তে প্রমাণ করতে চাই। সাধ্যকে প্রমাণ করা হয় পক্ষে, অর্থাৎ যেখানে সাধ্যের অধিষ্ঠান। এই সাধ্যই হল অনুমানের প্রমাণিত বিষয়। হেতুর সাহায্যেই আমরা পক্ষে সাধ্যকে প্রমাণ করি। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝানো যায়-
যেখানে যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে সেখানে আগুন আছে। দূরের ওই পাহাড়ে ধোঁয়া আছে।
দূরের ওই পাহাড়ে আগুন আছে।
এরূপ অনুমানের ক্ষেত্রে আগুন হল সাধ্য। কারণ এই আগুনকেই আমরা সিদ্ধান্তে প্রমাণ বা সিদ্ধ করতে চাই। অনুমানের ক্ষেত্রে তাই যাকে সাধন বা প্রমাণ করা হয়, তাকেই বলা হয় সাধ্য।
পক্ষ-এর ধারণা: সাধ্যকে যেখানে সিদ্ধ বা প্রমাণ করা হয়, তাকেই বলা
হয় পক্ষ। এই পক্ষ হল সাধ্যের অধিষ্ঠান। পক্ষে সাধ্যের বিষয়ে সন্দেহ হলে তবেই আমরা অনুমানে প্রবৃত্ত হই। সেকারণেই বলা হয়েছে যে, সন্দিগ্ধ সাধ্যবানই হল পক্ষ। অবশ্য এরূপ অভিমতটি হল প্রাচীনপন্থীদের। কিন্তু নব্যরা দাবি করেন যে, পক্ষতার আশ্রয়কেই বলা হয় পক্ষ। পক্ষের যে ধর্ম, তা-ই হল পক্ষতা। পক্ষেই সাধ্যের সিদ্ধি বা প্রমাণ হয়। যেমন- যেখানে যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে সেখানে আগুন আছে।
দূরের ওই পাহাড়ে ধোঁয়া দেখা যায়।
.. দূরের ওই পাহাড়ে আগুন আছে।
এই অনুমানের ক্ষেত্রে দূরের ওই পাহাড় হল পক্ষ। কারণ, এখানেই আমরা সাধ্য তথা আগুনকে প্রমাণ করি। তাই অনুমানের ক্ষেত্রে আমরা যে স্থানে সাধ্যকে সিদ্ধ করি, তা-ই হল পক্ষ।
হেতুর ধারণা: যার দ্বারা সাধ্যকে পক্ষে প্রমাণ বা সিদ্ধ করা হয়, তাকেই বলা হয় হেতু। হেতুর অপর নাম হল লিঙ্গ বা সাধন। যে-কোনো অনুমানে সাধারণত হেতু তথা লিঙ্গের ওপর নির্ভর করেই পক্ষে সাধ্যকে সিদ্ধ বা প্রমাণ করা হয়। অনুমানের ক্ষেত্রে এই হেতুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ হেতুর উপস্থিতি ছাড়া পক্ষ এবং সাধ্যের মিলন কখনোই সম্ভব নয়। ফলে, হেতুর অবর্তমানে পক্ষে সাধ্যের প্রমাণটি অসম্ভব হয়। হেতুকে তাই মধ্যম পদরূপেও উল্লেখ করা যায়। যেমন-
যেখানে যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে সেখানে আগুন আছে। দূরের ওই পাহাড়ে ধোঁয়া আছে।
.. দূরের ওই পাহাড়ে আগুন আছে।
এই অনুমানের ক্ষেত্রে ধোঁয়া হল হেতু। কারণ, এই ধোঁয়ার দ্বারাই আমরা আগুন তথা সাধ্যকে দূরের ওই পাহাড় তথা পক্ষে প্রমাণ করতে পারি। এই হেতু পদটি সাধ্য এবং পক্ষ পদের মধ্যে ঘটকের কাজ করে বলে একে বলা হয় মধ্যম পদ।