আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা, সন্নিধি ও তাৎপর্য
নৈয়ায়িকদের মতে, বাক্যের বাক্যার্থ কতকগুলি শর্তের ওপর নির্ভর করে। এই শর্তগুলি হল যথাক্রমে-[1] আকাঙ্ক্ষা, [2] যোগ্যতা, [3] সন্নিধি এবং [4] তাৎপর্য। এই সমস্ত শর্তকে পর্যায়ক্রমিকভাবে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
আকাঙ্ক্ষা
আকাঙ্ক্ষার অর্থ হল বাক্যস্থিত একটি পদের সঙ্গে অন্য একটি পদের অন্বয় বোধ। ন্যায় মতে, বাক্যস্থিত বিভিন্ন পদকে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হতে হয়। কারণ, পদগুলি সম্বন্ধযুক্ত না হলে বাক্যটি কখনোই অর্থপূর্ণভাবে বিবেচিত হতে পারে না। পদগুলি পারস্পরিকভাবে সম্বন্ধযুক্ত হলে তবেই একটি পদ আর-একটি পদের প্রয়োজনীয় বলে দাবি করা হয়। পদগুলি পারস্পরিকভাবে প্রয়োজনীয় না হলে, তা কখনোই অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ঘট পট তন্তু মৃত্তিকা-
এরূপ অগোছালোভাবে পদসমন্বয় কখনোই অর্থপূর্ণ বাক্য নয়। কারণ, এক্ষেত্রে পদগুলি একে অপরের প্রয়োজন সিদ্ধ করে না। সুতরাং, অর্থপূর্ণ বাক্যের ক্ষেত্রে যে পদের সঙ্গে যে পদের অন্বয় বা সম্বন্ধ আছে, সেখানে সেই পদকেই ব্যবহার করতে হয়। এরূপ নিয়ম অনুসরণ করেই আমরা বক্তার ভাব উপলব্ধি করতে সমর্থ হই। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, গাভিটিকে নিয়ে এসো-বাক্যটির অন্তঃস্থিত পদসমূহ একে অপরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বা প্রয়োজনীয় বলেই তা অর্থপূর্ণরূপে বিবেচিত। পদগুলি এককভাবে তাই কখনোই অর্থপূর্ণরূপে বিবেচিত হতে পারে না। সুতরাং, বাক্যের অন্তঃস্থিত পদসমূহের পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত প্রয়োজনীয়তাকেই বলা হয় আকাঙ্ক্ষা।
যোগ্যতা
যোগ্যতার অর্থ হল বাক্যস্থিত পদসমূহের মধ্যে পারস্পরিক অবিরোধ সম্পর্ক। অর্থাৎ, বাক্যস্থিত পদসমূহের মধ্যে পারস্পরিক বাধের অভাবই হল যোগ্যতা। যোগ্যতাকে তাই অর্থবোধের অভাবরূপে উল্লেখ করা হয়। অর্থের বাধ বা অসংগতি থাকলে কখনোই শব্দবোধ হয় না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, নদী থেকে জল সিঞ্চন করবে-এরূপ বাক্যটির ক্ষেত্রে পদসমূহের মধ্যে অবিরোধ সম্বন্ধ থাকায় তা অর্থপূর্ণ বলে বিবেচিত। কিন্তু যদি বলা হয় যে, অগ্নিকুণ্ড থেকে জল সিঞ্চন করবে, তাহলে পদগুলির ক্ষেত্রে অর্থবোধ বা অর্থের অসংগতি থাকায় তা কখনোই অর্থবহরূপে গণ্য নয়। যোগ্যতাকে তাই বাক্যের অন্তঃস্থিত পদসমূহের ক্ষেত্রে অর্থের দ্যোতকরূপে গণ্য করা হয়।
সন্নিধি
সন্নিধির অর্থ হল বাক্যের অন্তর্গত পদসমূহের অনতিবিলম্বে উচ্চারণ বা স্মরণ। সন্নিধি তাই পদসমূহের অন্তঃস্থিত সময় নৈকট্যকেই বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, গাভি আনয়ন করো-বাক্যটির অন্তর্গত তিনটি পদকে তাৎক্ষণিকভাবে পরপর একসঙ্গে উচ্চারণ করলে তবেই বাক্যটি অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে নির্দেশিত ব্যক্তিটি গাভি আনয়ন করতে সমর্থ হয়। কিন্তু যদি সকালে গাভি শব্দটি, দুপুরে আনয়ন শব্দটি এবং সন্ধ্যায় করো শব্দটি উচ্চারিত হয়, তাহলে ওই সমস্ত পদের সন্নিধি তথা আসক্তির অভাব হেতু বাক্যটি কখনোই অর্থবহরূপে গণ্য হতে পারে না। ফলত বাক্যস্থিত অর্থকে যথাযথভাবে প্রকাশ করার জন্যই তার অন্তঃস্থিত পদসমূহের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে সন্নিধির প্রয়োজন।
তাৎপর্য
তাৎপর্যের অর্থ হল পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বক্তার ঈপ্সিত অর্থ। বাক্যের প্রকৃত অর্থ তাই বক্তার ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের ওপর নির্ভরশীল। বক্তার এরূপ ইচ্ছা বা অভিপ্রায়কেই বলা হয় তাৎপর্য। একটি বিশেষ অর্থকে সূচিত করার নিমিত্তই বক্তা কোনো বাক্যে কিছু নির্দিষ্ট পদ ব্যবহার করে থাকেন। বাক্যস্থিত পদের সেই বিশেষ অর্থই হল তার তাৎপর্য। ফলত বক্তার ইচ্ছা বা অভিপ্রায় সম্পর্কে নিশ্চিত না হলে, বাক্যস্থিত পদের অন্তর্নিহিত অর্থকেও অনুধাবন করা কখনোই সম্ভব নয়। অন্তর্নিহিত অর্থের যথাযথ অনুধাবনই হল তাৎপর্যের মূল অর্থ। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, সৈন্ধব আনয়ন করো-এরূপ বাক্যের ক্ষেত্রে বক্তার ঠিক অভিপ্রায় কী, তা জানা না থাকলে ওই বাক্যের প্রকৃত অর্থটিকে চয়ন করা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ, সৈন্ধব পদটির একটির অর্থ হল সিন্ধু দেশীয় অশ্ব এবং আর-একটি অর্থ হল সৈন্ধব লবণ। সুতরাং, এক্ষেত্রে বচনটি ঠিক কী বলতে চায়, তার যথাযথ উপলব্ধির জন্য পদের তাৎপর্য অনুধাবন করা একান্ত প্রয়োজন।