বার্কলের আত্মগত ভাববাদ কি একটি গ্রহণযোগ্য মতবাদ?

বার্কলের আত্মগত ভাববাদের গ্রহণযোগ্যতা

বার্কলের আত্মগত ভাববাদ সূক্ষ্ম যুক্তিতর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও তা কখনোই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। আত্মগত ভাববাদের মূল সূর হল-জ্ঞেয় বস্তু জ্ঞাতা মনের ভাব বা ধারণা মাত্র। আত্মগত ভাববাদের মূলনীতির বিরুদ্ধে নব্য বস্তুবাদীরা সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। আত্মগত ভাববাদের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগগুলি হল-

লৌকিক জ্ঞানের পরিপন্থী: 

লৌকিক জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জানি যে, বাহ্যবস্তুর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা রয়েছে। আমরা এই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বাহ্যবস্তুগুলিকে শুধু মূর্ত বস্তুরূপেই জানি, কখনোই আমরা সেগুলিকে ধারণারূপে জানি না। কিন্তু বার্কলের আত্মগত ভাববাদ সেগুলিকে শুধু ধারণা বলেই দাবি করে। নব্য বস্তুবাদী দার্শনিক ম্যুর এই লৌকিক বা সাধারণ জ্ঞানের সপক্ষে অত্যন্ত জোরালো যুক্তি দেখিয়েছেন। কিন্তু বার্কলের আত্মগত ভাববাদ এই লৌকিক জ্ঞানের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। সে কারণেই বার্কলের ভাববাদকে লৌকিক জ্ঞানের পরিপন্থীরূপে গণ্য করা হয়। 

অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর তত্ত্ব খণ্ডন: 

নব্য বস্তুবাদী দার্শনিক ম্যুর তাঁর 'ভাববাদ খণ্ডন', নামক আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, বার্কলের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর তত্ত্বটি যথার্থ নয়। কারণ, আমরা বাস্তব জগতে বস্তুকেই দেখি, কখনোই বস্তুর ভাবকে দেখি না। তাঁর মতে, বস্তু আছে বলেই বস্তুর ভাব আমাদের মনে প্রতিভাত হয়। বস্তুর ভাবের মাধ্যমে বস্তু কখনোই প্রতিভাত হয় না। তাই বলা উচিত যে, প্রত্যক্ষই হল বস্তুর অস্তিত্বনির্ভর।

অহংসর্বস্ববাদের দোষে দুষ্ট: 

নব্য বস্তুবাদী দার্শনিক পেরি বার্কলের আত্মগত ভাববাদের বিরুদ্ধে অহংসর্বস্ববাদের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, অহংসর্বস্ববাদ কখনোই জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি গ্রহণীয় মতবাদরূপে গণ্য হতে পারে না। কারণ, তা জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত না করে, তাকে সংকুচিতই করে। অহংসর্বস্ববাদ শুধু জ্ঞাতার মন ও তার ধারণাকেই স্বীকার করে, অন্য কোনো কিছুকেই নয়। সুতরাং, বার্কলের আত্মগত ভাববাদ কখনোই একটি গ্রহণযোগ্য মতবাদরূপে গণ্য হতে পারে না।

অভিজ্ঞতাবাদের অসংগতিতে ঈশ্বরের ধারণা: 

অহংসর্বস্ববাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বার্কলে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু ঈশ্বরের স্বীকৃতি মূল অভিজ্ঞতাবাদের সঙ্গে কখনোই সংগতিপূর্ণ নয়। কারণ, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে কখনোই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লাভ করা যায় না। অথচ একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকরূপে গণ্য হয়েও বার্কলে তাঁর ভাববাদে কীভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন, তা আদৌ বোধগম্য নয়।

অযৌক্তিকভাবে মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণের পার্থক্যকে অস্বীকার: 

বার্কলে তাঁর আত্মগত ভাববাদে বস্তুর মুখ্য ও গৌণ গুণের পার্থক্যকে অস্বীকার করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সমস্ত গুণই ব্যক্তির মননির্ভর। 
কিন্তু নব্য বস্তুবাদীরা কখনোই এ কথা স্বীকার করেন না। কারণ, বস্তুর সমস্ত গুণ কখনোই এক ধরনের হতে পারে না। বস্তুর বিস্তৃতি নামক মুখ্য গুণটি কখনোই বস্তুর রূপ বা রঙের সঙ্গে এক হতে পারে না। বস্তুর রূপ জ্ঞাতার মনের ওপর নির্ভরশীল হলেও, বস্তুর বিস্তৃতি কখনোই জ্ঞাতার ভাব বা মনের ওপর নির্ভরশীল নয়। সুতরাং, মুখ্য ও গৌণ গুণের পার্থক্যকে অস্বীকার করা একান্তভাবেই অযৌক্তিক।

অর্থের অস্পষ্টতায় 'ধারণা' শব্দটি প্রয়োগের অসম্ভাব্যতা: 

প্রখ্যাত আধুনিক বিশ্লেষণী দার্শনিক (analytical philosopher) বার্ট্রান্ড রাসেল বার্কলের আত্মগত ভাববাদের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন যে, বার্কলে তাঁর ভাববাদে 'ধারণা' শব্দটিকে স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত করতে পারেননি। কারণ, তিনি ধারণা বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। ধারণা বলতে কখনও তিনি বস্তুকে, আবার কখনো বস্তুর চিন্তাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু বস্তু এবং বস্তুর চিন্তা কখনোই এক হতে পারে না। সেকারণেই বার্কলের আত্মগত ভাববাদ একটি উদ্ভট মতবাদরূপে গণ্য।

Popular posts from this blog

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান আলোচনা করো।

কার্যকারণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে হিউমের মতবাদটি আলোচনা করো।

নেপোলিয়নের পতনের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করো।