বার্কলের ডাববাদের মূল বক্তব্য
ভাববাদের মূল বক্তব্য এই যে, জ্ঞেয় বস্তুর মননিরপেক্ষ কোনো সত্তা নেই, তা সম্পূর্ণভাবেই আমাদের মননির্ভর। আমাদের মনের বাইরে বাহ্যবস্তুর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্বই নেই। জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের চৈতন্য তথা ভাবই পরমতত্ত্বরূপে গণ্য। তাই ভাববাদ বস্তুবাদের ঠিক বিপরীত এক মতবাদরূপে গণ্য।
ভাববাদের বিভিন্ন রূপ:
বস্তুবাদের মতো ভাববাদেরও বিভিন্ন রূপ দেখা
যায়। ভাববাদকে প্রাথমিকভাবে দুটি প্রকারে বা রূপে বিভক্ত করা যায়- [i] জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাববাদ এবং [ii] পরাতাত্ত্বিক ভাববাদ। জ্ঞানের প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করে যদি ভাববাদে উপনীত হওয়া যায়, তাহলে তাকে বলা হয় ভাববাদে উপনীত হওয়া যায়, তাহলে তাকে বলা হয় পরাতাত্ত্বিক ভাববাদ।
জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাববাদের বিভিন্ন রূপ:
জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাববাদের আবার দুটি রূপ লক্ষ করা যায়- [i] আত্মগত ভাববাদ এবং [ii] সবিচার ভাববাদ। আত্মগত ভাববাদের প্রবক্তা হলেন প্রখ্যাত অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জর্জ বার্কলে। আর, সবিচার ভাববাদের প্রবক্তা হলেন প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। আত্মগতভাববাদ অনুযায়ী দাবি করা হয় যে, জ্ঞেয় বস্তু জ্ঞাতার চেতনার বৃত্তি বা ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সবিচার ভাববাদ অনুসারে জ্ঞেয় বস্তু বহুলাংশে জ্ঞাতার মনের গঠনপ্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল।
বার্কলের আত্মগত ভাববাদ
প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জর্জ বার্কলের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদটি আত্মগত ভাববাদ (subjective idealism) নামে খ্যাত। যে জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদে জ্ঞেয় বস্তু বা বিষয়ের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কোনো বাহ্যসত্তাকে স্বীকার করা হয় না এবং দাবি করা হয় যে, বস্তু বা বিষয়ের অস্তিত্ব জ্ঞাতার মন বা ধারণা তথা আত্মজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল-তাকেই বলা হয় আত্মগত ভাববাদ।
লকের প্রতিরূপী বন্ধুবাদের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বার্কলের আত্মগত ভাববাদ:
দার্শনিক লকের প্রতিরূপী বস্তুবাদের অনিবার্য
পরিণতি হল বার্কলের আত্মগত ভাববাদ। কারণ, জ্ঞাতার মননিরপেক্ষভাবে বাহ্যবস্তুর কোনো অস্তিত্বই নেই। জ্ঞেয় বস্তু তাই জ্ঞাতার চেতনার বৃত্তি বা ধারণারূপে গণ্য। বার্কলের মতে, বস্তু বা বস্তুর ধর্ম হল জ্ঞাতার মনোমধ্যস্থ ধারণা রূপে গণ্য হওয়া।
লকের সঙ্গে বার্কলের মতবাদের পার্থক্য:
দার্শনিক লক দাবি করেন যে, দ্রব্যরূপী জড়বস্তুকে আমরা কখনোই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় পাই না। আমরা আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় যা পাই, তা হল বস্তুর প্রতিরূপ বা ধারণা। লকের এরূপ অভিমতের সঙ্গে বার্কলে অবশ্যই ঐক্যমত পোষণ করেন। কিন্তু লকের সঙ্গে বার্কলের মতবাদের মূল পার্থক্য এই যে-গুণের অতিরিক্ত যে অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় জড়বস্তুর অস্তিত্বের কথা লক স্বীকার করেছেন, বার্কলে তা অস্বীকার করেছেন। বার্কলে দাবি করেন যে, জড়দ্রব্য আছে অথচ তা প্রত্যক্ষবহির্ভূত-লকের এরূপ অভিমত স্ববিরোধিতাপূর্ণ এবং অভিজ্ঞতাবাদের বিরোধী। বার্কলে তাই দাবি করেন যে, বস্তুর অস্তিত্বের অর্থই হল তা জ্ঞাতার প্রত্যক্ষগোচর হওয়া। তিনি এই বিষয়টিকেই তাঁর বিখ্যাত অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর (Esse est Percipi) তত্ত্বের মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন।
বার্কলের ভাববাদকে আত্মগত ভাববাদ বলার কারণ:
বার্কলের ভাববাদকে আত্মগত ভাববাদরূপে অভিহিত করা হয়, কারণ তাঁর মতে, ধারণার অর্থই হল জ্ঞাতার মনোমধ্যস্থ ধারণা। ধারণার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হলে, জ্ঞাতার মনের অস্তিত্বকেও স্বীকার করে নিতে হয়। সুতরাং, ধারণা যেমন আছে, তেমনই মনও আছে। ধারণা এবং ব্যক্তি তথা জ্ঞাতা মনের অস্তিত্ব সংশয়াতীত। মন এবং ধারণা ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। সমস্ত কিছুই তাই জ্ঞাতার মনের ধারণারূপে গণ্য। ফলে, বার্কলের ভাববাদকে আত্মগত ভাববাদরূপে গণ্য করাই সংগত।