ভাববাদ
ভাববাদ হল বস্তুবাদের একটি বিপরীত মতবাদ। যে জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ অনুসারে জ্ঞানের বিষয় তথা জ্ঞেয় বস্তুর কোনো স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ সত্তা নেই এবং তা জ্ঞাতার মন বা চেতনার ওপর নির্ভরশীল, সেই জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদকেই বলা হয় ভাববাদ (idealism)। ভাববাদ অনুসারে বাহ্যবস্তুরূপে যা কিছু অস্তিত্বশীল বলে আমরা দাবি করি, তার সমস্ত কিছুই জ্ঞাতার মন বা ধারণার ওপর নির্ভরশীল। জ্ঞাতার মন বা ধারণার বাইরে এদের আলাদা কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই।
ডাববাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ভাববাদের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল-
[1] জ্ঞাতার মন বা ধারণার ওপর জ্ঞেয় বস্তুর নির্ভরশীলতা:
ভাববাদ অনুযায়ী জ্ঞানের বিষয় তথা জ্ঞেয় বস্তু কখনোই জ্ঞাতার মন বা ধারণা ছাড়া থাকতে পারে না। জ্ঞানের বিষয় জ্ঞাতার মনের ওপর নির্ভরশীল। জ্ঞাতার মন আছে বলেই বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়। জ্ঞাতার মন বা ধারণাবহির্ভূতভাবে জ্ঞেয় বস্তু কখনোই অস্তিত্বশীল হতে পারে না।
[2] জ্ঞেয় বস্তুর বস্তুগত সত্যতার অভাব:
ভাববাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জ্ঞেয় বস্তুর কোনো স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বাস্তব সত্তা নেই। অর্থাৎ, জ্ঞেয় বস্তুর কোনোপ্রকার বস্তুগত সত্যতা নেই। তাই ভাববাদ জ্ঞেয় বস্তুর বস্তুগত সত্যতাকে অস্বীকার করে এবং জ্ঞাতামনের ধারণাগত সত্যতাকেই স্বীকার করে।
[3] বস্তুবাদের বিপরীত মতবাদ হিসেবে ভাববাদ:
বস্তুবাদ অনুসারে বাহ্যজগতে জ্ঞেয় বস্তুর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। কিন্তু ভাববাদ অনুযায়ী জ্ঞেয় বস্তুর কোনো স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব শুধু জ্ঞাতার মন বা ধারণার ওপর নির্ভরশীল এবং ধারণার জগতেই
সীমায়িত। সুতরাং, ভাববাদ বস্তুবাদের বিপরীত বিষয়কেই উল্লেখ করে।
[4] জ্ঞেয় বন্ধু ও জ্ঞাতার আন্তর ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক:
ভাববাদে দাবি করা হয় যে, জ্ঞাতা মনের সঙ্গে জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্ক কখনোই বাহ্যিক নয়, তা হল অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক। আর এরূপ সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্যরূপেই গণ্য। জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাববাদ। অপরদিকে, সত্তার প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করে যদি কারণ, জ্ঞাতার মন বা ধারণা থেকে জ্ঞেয় বস্তুকে কখনোই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। জ্ঞাতার মননিরপেক্ষভাবে বাহ্যবস্তু তাই কখনোই অস্তিত্বশীল নয়।
[5] জ্ঞেয় বস্তুর স্বরূপ নির্ধারক হিসেবে জ্ঞাতার মন:
ভাববাদের মূল দাবি হল যে, আমাদের মনই হল বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব ও স্বরুপের নির্ণায়ক। জ্ঞাতার মন ছাড়া জ্ঞেয় বস্তুর স্বরূপ নির্ণয় এক অবান্তর প্রয়াস মাত্র। আয়নায় বস্তুর বা ব্যক্তির রূপ যেমন যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়, তেমনই জ্ঞাতার মনের ধারণায় জ্ঞেয় বস্তুর স্বরূপ যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়।
[6] প্রত্যক্ষের ওপর বস্তুর অস্তিত্বের নির্ভরশীলতা:
ভাববাদী দার্শনিক বার্কলে উল্লেখ করেন যে, বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে তার ব্যক্তিমনের প্রত্যক্ষের ওপর। এভাবেই তিনি তাঁর বিখ্যাত অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর তত্ত্বে উপনীত হয়েছেন। তাঁর মতে, এমন কোনো বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না, যা ব্যক্তিমনের দ্বারা প্রত্যক্ষিত নয়।
[7] পরমসত্তারূপে ঈশ্বরের স্বীকৃতি:
ভাববাদে সমস্ত জাগতিক ঘটনার পশ্চাতে পরমসত্তারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। এটি ভাববাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেসব পার্থিব ঘটনা ব্যক্তিমনের ধারণায় ধরা দেয় না, তা ধরা পড়ে ঈশ্বরের ধারণায়। ভাববাদে ঈশ্বর তাই সর্বদ্রব্য দ্রষ্টারূপে গণ্য। সুতরাং, ভাববাদ পার্থিব বৈচিত্র্যসমূহের মধ্যেও এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে। এই পরমসত্তারূপী ঈশ্বরকেই বলা হয় সার্বিক প্রত্যক্ষ কর্তা।