নরমপন্থী বুদ্ধিবাদ
জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত যে-সমস্ত মতবাদ প্রচলিত, তাদের মধ্যে বুদ্ধিবাদ হল অন্যতম। বুদ্ধিবাদ অনুসারে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাকেই জ্ঞানের উৎসরূপে দাবি করা হয়। বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাকে জ্ঞানের উৎসরূপে স্বীকার করে নিলেও বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার ভূমিকা নিয়ে সমস্ত বুদ্ধিবাদী দার্শনিক কিন্তু কখনোই ঐক্যমত পোষণ করেন না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিবাদের দুটি রূপ লক্ষ করা যায়। এদের একটি হল চরমপন্থী বুদ্ধিবাদ (extreme rationalism) এবং অন্যটি হল নরমপন্থী বুদ্ধিবাদ (moderate rationalism) |
জ্ঞানের উৎস বুদ্ধি হলেও তা একমাত্র উৎস নয়:
নরমপন্থী বুদ্ধিবাদ অনুসারে বুদ্ধি জ্ঞানের মূল উৎসরূপে গণ্য হলেও, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস নয়। বুদ্ধি ছাড়াও জ্ঞানের আরও অন্যান্য উৎস থাকতে পারে। সুতরাং, চরমপন্থী বুদ্ধিবাদীরা যেখানে বুদ্ধিকেই জ্ঞানের একমাত্র উৎসরূপে দাবি করেছেন, সেখানে নরমপন্থী বুদ্ধিবাদীরা তা পুরোপুরি মানেননি। তাঁরা জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় সংবেদনের ভূমিকার কথা একেবারেই অস্বীকার করেননি। নরমপন্থী বুদ্ধিবাদীদের অন্যতম হলেন, স্পিনোজা, লাইবনিজ, ইমানুয়েল কান্ট প্রমুখ দার্শনিক।
জ্ঞানের বিভাজনে নরমপন্থী বুদ্ধিবাদ:
নরমপন্থী বুদ্ধিবাদীরা জ্ঞানকে দু-ভাগে বিভক্ত করেছেন- [1] যথার্থ তথা সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান এবং [2] নিকৃষ্ট ধরনের জ্ঞান। যথার্থ তথা সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান বিশুদ্ধ বুদ্ধি তথা প্রজ্ঞার দ্বারা লাভ করা গেলেও, নিকৃষ্ট ধরনের জ্ঞান ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতার দ্বারা লাভ করা যায়। সুতরাং, অভিজ্ঞতার দ্বারা যে-কোনো জ্ঞানই লাভ করা যায় না, বা তা জ্ঞানের উৎসরূপে আদৌ গণ্য হতে পারে না, এরকম দাবি আদৌ সংগত নয়। নরম বা উদারপন্থী দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের মত অনুসরণ করে বলা যায় যে, জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধি উভয়েরই প্রয়োজন আছে। একটিকে ছাড়া অন্যটি অন্ধ বা শূন্যগর্ভরূপে গণ্য। কান্ট দাবি করেন যে, জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় জ্ঞানের উপাদান যেমন প্রয়োজন, তেমনই তার আকারও প্রয়োজন। কেবল উপাদান বা আকার দিয়ে কখনোই জ্ঞান সৃষ্টি হতে পারে না। জ্ঞানের এই উপাদান পাওয়া যায় ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে। অপরদিকে, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি বা বোধশক্তি জ্ঞানের আকার (form) প্রদান করে। জ্ঞান তাই কেবল অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধির একক ফসল নয়। এ হল বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার যৌথ প্রয়াস। সুতরাং, নরমপন্থী বুদ্ধিবাদীদের মতে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা জ্ঞানের মৌল উৎসরূপে গণ্য হলেও, তা কখনোই একমাত্র উৎস নয়।
স্পিনোজাও দাবি করেন যে, আমরা জ্ঞান লাভ করি বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়
স্পিনোজা ও লাইবনিজের অভিমত:
উদারপন্থী বুদ্ধিবাদী দার্শনিক অভিজ্ঞতা-উভয়ের মাধ্যমে। তিনি এও দাবি করেন যে, আমরা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় যে জ্ঞান লাভ করি তা অসম্পূর্ণ ও দুর্বোধ্য। কিন্তু বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমে যে জ্ঞান পাই, তা যথার্থ ও সম্পূর্ণ। অনুরূপভাবে লাইবনিজ 'বুদ্ধিলব্ধ সত্যজ্ঞান' ও 'বাস্তব ঘটনা বিষয়ক জ্ঞান'—উভয়প্রকার জ্ঞানকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রথম ধরনের জ্ঞান লাভ করা যায় শুধু বিশুদ্ধ বুদ্ধি দ্বারা, কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের জ্ঞান পাওয়া যায় আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদন দ্বারা। সুতরাং, নরমপন্থী বুদ্ধিবাদীরা কখনোই কেবল বুদ্ধিকে জ্ঞানের উৎসরূপে স্বীকার করেন না।
যথার্থ নরমপন্থী হিসেবে কান্টের মতবাদ:
প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টকেই প্রকৃত নরমপন্থী বুদ্ধিবাদী হিসেবে অভিহিত করা উচিত। কারণ, কান্ট দাবি করেন যে, জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধি উভয়েরই প্রয়োজন আছে। একটিকে ছাড়া অন্যটি অন্ধের মতো। তাঁর মতে, জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে জ্ঞানের উপাদানের যেমন প্রয়োজন, তেমনই তার আকারেরও প্রয়োজন। শুধু উপাদান এবং আকার দিয়ে জ্ঞানলাভ আদৌ সম্ভব হয় না। জ্ঞানের উপাদান আসে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা থেকে, আর তার আকার লাভ হয় বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে। সুতরাং, জ্ঞান হল বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা-উভয়ের যৌথ ফসল।