জ্ঞানের উৎস ও স্বরূপ সম্পর্কে লকের বক্তব্য
প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক হলেন একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। তিনি বুদ্ধিবাদের বিরোধিতা করে দাবি করেন যে, বুদ্ধি নয়, অভিজ্ঞতাই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস। আর যে মতবাদ অনুযায়ী দাবি করা হয়-ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস-সেই মতবাদকেই বলা হয় অভিজ্ঞতাবাদ (empiricism)। অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে সার্বিক ও নিশ্চিত জ্ঞান যে লাভ করা যায়-তা প্রথম প্রমাণ করেন বৈজ্ঞানিক নিউটন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, দার্শনিক লক পরবর্তীকালে এরূপ মতবাদটিকে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদে ভূষিত করেছেন।
লকের অভিমত:
লক দাবি করেন যে, আমাদের মনে এমন কিছুই নেই যা পূর্বে আমাদের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় ছিল না। সেকারণেই তিনি আমাদের মনে আগে থেকে থাকা সহজাত ধারণা (innate ideas)-র বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। বুদ্ধিবাদী দার্শনিক দেকার্ত জন্মের পূর্ব থেকে আমাদের মনে সহজাত ধারণার বিষয়টিকে স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু লক এরূপ বিষয়টিকে নস্যাৎ করেছেন। তিনি বলেন জন্মের সময়ে আমাদের মন থাকে এক অলিখিত সাদা কাগজের মতো (tabula rasa)। ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় আমাদের মনে নানারকম ধারণা (ideas) মুদ্রিত হয় এবং আমরা এই ধারণার মাধ্যমেই পরোক্ষভাবে বস্তুজ্ঞান লাভ করে থাকি।
লকের মতে জ্ঞানের স্বরূপ:
লকের মতে, জ্ঞান হল ধারণাসমূহের মধ্যে মিল বা অমিল। এই ধারণা গঠিত হয় সরাসরিভাবে দেখা বস্তুর গুণের মাধ্যমে। লক দাবি করেন যে, আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়বৃত্তির দ্বারা সরাসরিভাবে যা প্রত্যক্ষ করি, তা হল বস্তুর গুণ (quality)। এই গুণ হল দু- প্রকারের-মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণ। মুখ্য গুণ হল বস্তুর অবিচ্ছেদ্য গুণ, আর গৌণ গুণ হল বস্তুর ওপর ব্যক্তিমনের বা জ্ঞাতার আরোপিত গুণ। এই উভয়প্রকার গুণ দিয়ে গঠিত হয় ধারণা। এই ধারণার মাধ্যমে বস্তুকে পরোক্ষভাবে জানা যায়। ধারণাকে তাই বলা হয় বাহ্যবস্তুর প্রতিনিধি। সেকারণেই লকের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদকে বলা হয় প্রতিনিধিমূলক বস্তুবাদ বা প্রতিরূপী বস্তুবাদ। লকের বক্তব্যের সমালোচনা লকের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ সূক্ষ্ম যুক্তিতর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও, তা কখনোই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।
লকের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের বিরুদ্ধে যে সমালোচনাগুলির উল্লেখ করা যায়, এর সেগুলি হল:
i. একপেশে মতবাদ: শুধু ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করায় এবং বুদ্ধিবৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব না দেওয়ায় লকের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ একটি একপেশে মতবাদে পরিণত হয়েছে। কারণ, জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধিরও যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে-তা অস্বীকার করা যায় না।
ii. অবরোহমূলক পদ্ধতির উপেক্ষা: দার্শনিক লক তাঁর জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় বিশেষ বিশেষ বস্তুর ধারণার মাধ্যমে আরোহমূলক পদ্ধতিতে জ্ঞানের বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে আরোহমূলক পদ্ধতি ছাড়াও যে অবরোহমূলক পদ্ধতির ভূমিকা আছে—তা অস্বীকার করা যায় না।
iii. ধারণাকে প্রত্যক্ষ করে পরোক্ষ বস্তুজ্ঞান লাভ অসমর্থনযোগ্য: বস্তু হল মূর্ত বিষয়, কিন্তু ধারণা হল অমূর্ত বিষয়। ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা মূর্ত বিষয়কেই দেখতে পারি, অমূর্ত বিষয়কে নয়। অথচ লক দাবি করেন যে, আমরা সরাসরিভাবে ধারণাকে প্রত্যক্ষ করেই পরোক্ষ বস্তুজ্ঞান লাভ করি। একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিসেবে লকের এরূপ মতটি কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়।