হিউমের কার্যকারণ সম্পর্কিত মতবাদের বিরুদ্ধে যুক্তি
কার্যকারণ সম্পর্কে হিউম অনিবার্য বা অবশ্যম্ভাবী মতবাদ অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, কার্যকারণ সম্বন্ধ হল দুটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার মধ্যে একপ্রকার পরস্পরনির্ভর সম্পর্ক, যা সতত বা সর্বদাই বিদ্যমান। কার্যকারণ সম্পর্কিত হিউমের মতবাদটি সতত সংযোগ তত্ত্ব নামে খ্যাত। কিন্তু অনেকেই, বিশেষ করে বুদ্ধিবাদী দার্শনিকগণ কার্যকারণ সম্পর্কিত এরূপ মতবাদকে সমর্থন করতে পারেননি। এমনকি বলা যায় যে, অভিজ্ঞতাবাদী হয়েও প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক এবং জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ দার্শনিক কার্য ও কারণের অন্তঃস্থিত সম্পর্ককে স্বীকার করে নিয়েছেন। কার্যকারণ সম্পর্কিত হিউমের মতবাদের বিরুদ্ধে যেসকল অভিযোগগুলি উত্থাপিত করা যায়-
প্রথম যুক্তি: দুটি ঘটনার পারম্পর্য সবসময় কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সমর্থ নয়। হিউম দাবি করেছেন যে, কার্য ও কারণ রূপ দুটি ঘটনাকে একসঙ্গে পরপর ঘটতে দেখে আমাদের এমন একপ্রকার মানসিক প্রবণতার সৃষ্টি হয় যে, আমরা একটিকে দেখে আর-একটির প্রত্যাশা করে থাকি। অর্থাৎ, তাদের মধ্যে একপ্রকার কার্যকারণ সম্পর্ককে স্বীকার করি। কিন্তু দুটি ঘটনা পরপর একসঙ্গে ঘটলে সর্বদাই যে তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন মনে করার কোনো কারণই নেই। উদাহরণস্বরূপ, দিন ও রাত্রি পরপর আসে যায়, কিন্তু তাদের মধ্যে যে কার্যকারণ সম্পর্ক আছে, এমন দাবি করা যায় না।
দ্বিতীয় যুক্তি: অভিজ্ঞতার দ্বারা লব্ধ নয় অনেক বিষয়ও কার্যকারণ সম্বন্ধে আবদ্ধ। হিউম দাবি করেছেন যে, আমরা কার্য ও কারণের বিষয়কে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লাভ করি। কিন্তু এমন অনেক বিষয় দেখা যায়, যেগুলি অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, অথচ কার্যকারণ বিষয়কে সূচিত করে। উদাহরণস্বরূপ, পারমাণবিক বিস্ফোরণ হল পৃথিবীর ধ্বংসের কারণ। এ সম্পর্কে আমাদের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও পারমাণবিক বিস্ফোরণ ও পৃথিবী ধ্বংস-এই দুয়ের মধ্যে যে কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে, তা একেবারেই অস্বীকার করা যায় না।
তৃতীয় যুক্তি: পারম্পর্য ছাড়াও দুটি ঘটনার মধ্যে কার্যকারণের সম্ভাবনা।
হিউম উল্লেখ করেছেন যে, দুটি ঘটনার মধ্যে পারম্পর্য লক্ষ করেই কার্যকারণ সম্বন্ধকে আমরা প্রত্যাশা করে থাকি। কিন্তু পারম্পর্যহীন দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যেও কার্যকারণ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি রাস্তায় হাঁটার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বাস চাপা পড়ে মারা গেলে। এখানে-'মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া' এবং 'বাস চাপা পড়া'-র মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ কল্পিত হয়। কিন্তু এরূপ ঘটনা দুটির কখনোই সতত বা নিয়ত প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়।
চতুর্থ যুক্তি: হিউমের মতবাদে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ভবিষ্যদ্বাণী অচল।
হিউমের কার্যকারণ সম্পর্কিত সতত সংযোগ তত্ত্বকে স্বীকার করে নিলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ভবিষ্যদ্বাণীরও কোনো গুরুত্ব থাকে না। সততসংযোগের অভাবে এগুলি অব্যাখ্যাতই থেকে যায়। সুতরাং, কার্যকারণ সম্পর্কিত হিউমের সতত সংযোগ নীতিটি স্বচ্ছ ও নির্ঘণ্টরূপে গণ্য না হওয়ায়, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।