প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত (১৯১৯-৩৩ খ্রি.) হয়। এই সময় জার্মানিতে তীব্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে এবং নাৎসি নেতা অ্যাডল্ফ হিটলার (১৯৩৩-৪৫ খ্রি.) জার্মানির ক্ষমতা দখল করেন।
জার্মানিতে নাৎসি দলের/ হিটলারের উত্থান
জার্মানিতে হিটলার ও নাৎসি দলের ক্ষমতালাভ কোনো চমকপ্রদ, আকস্মিক বা বৈপ্লবিক ঘটনা ছিল না। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি দলের ক্ষমতা দখলের
প্রেক্ষাপট ছিল-
[1] ভার্সাই সন্ধির বিরোধিতা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তি ভার্সাই সন্ধির দ্বারা জার্মানির ওপর বিভিন্ন জবরদস্তিমূলক শর্ত চাপিয়ে দেয়। যেমন- [i] জার্মানির ওপর ৬৬০ কোটি পাউন্ডের বিরাট আর্থিক ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়। [ii] জার্মানির নৌ ও সামরিক বাহিনী ধ্বংস করা হয়। [iii] জার্মানির বিভিন্ন ভূখণ্ড কেড়ে নেওয়া হয়। জার্মানির প্রতি এই অবিচার জার্মানবাসীর মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। হিটলার এই ক্ষোভের সদ্ব্যবহার করেন।
[2] অর্থনৈতিক সংকট: ভাইমার প্রজাতন্ত্রের আমলে জার্মানি তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের শিকার হয়। যেমন- [i] ভার্সাই সন্ধির ক্ষতিপূরণের বোঝা জার্মান অর্থনীতিকে দিশেহারা করে দেয়। [ii] ত্রিশের দশকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দা জার্মানিকে প্রবলভাবে আঘাত করে। [iii] দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব
প্রভৃতি জার্মান জনজীবন বিধ্বস্ত করে দেয়। এই অবস্থায় হিটলার দেশবাসীকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি ক্ষমতায় এলে বেকারদের চাকরি দেবেন এবং অর্থনীতি মজবুত করবেন।
[3] গণতান্ত্রিক চেতনার অভাব: জার্মান রাজনীতিতে প্রথম থেকেই প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক চেতনার অভাব ছিল বলে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজটি সহজ হয়। গণতন্ত্রের পরিবর্তে জার্মানবাসী একনায়কতন্ত্রকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে।
[4] উগ্র জাতীয়তাবাদ: নাৎসি দল জাতিবিদ্বেষের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। নাৎসিতত্ত্ববিদ কার্ল হসোফার প্রচার করেন যে, বিশ্বের সকল জাতির মধ্যে শ্বেতাঙ্গরা শ্রেষ্ঠ। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে আবার জার্মান জাতি শ্রেষ্ঠ, কেননা তারা খাঁটি আর্য জাতির বংশধর। জার্মানদের মধ্যে আবার নাৎসিরা শ্রেষ্ঠ। জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের ফলে এই জাতির মধ্যে ঐক্যচেতনা বাড়ে।
[5] প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতা: ১৯১৯-'৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মানিতে মোট ১৯টি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। কিন্তু কোনো মন্ত্রীসভাই দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা আনতে পারেনি। প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতার সুযোগে নাৎসি দল নির্বাচনে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ১৪টি, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ১০৭টি এবং ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৮৮টি আসন দখল করে।
[6] পুঁজিপতিদের সহায়তা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জার্মানিতে কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের শক্তিবৃদ্ধি শিল্পপতি ও বুর্জোয়াদের আতঙ্কিত করে তোলে। পুঁজিপতিরা কমিউনিস্টদের দমনের উদ্দেশ্যে নাৎসি দলকে প্রচুর অর্থসাহায্য দেয়। এই সাহায্য পেয়ে নাৎসিরা কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী দলগুলিকে ভেঙে দেয়।
[7] নাৎসি সংগঠন: নাৎসি নেতা হিটলার তাঁর 'মাইন কাম্ফ'বা 'আমার সংগ্রাম' নামক গ্রন্থে নাৎসি দলের আদর্শ তুলে ধরেন। নাৎসি সদস্যরা তাঁদের সর্বোচ্চ নেতা 'ফুয়েরার' অর্থাৎ হিটলারকে সম্পূর্ণ অভ্রান্ত মনে
করে তাঁর নির্দেশ পালন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। হিটলার যুদ্ধ- ফেরত সেনা ও বেকার যুবকদের নিয়ে SA নামে আধা-সামরিক ঝটিকা বাহিনী গঠন করেন।
[৪] হিটলারের ব্যক্তিত্ব: নাৎসি দলের উত্থানের ক্ষেত্রে হিটলারের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ঐতিহাসিক অ্যালেন বুলক-
এর মতে, হিটলারের ব্যক্তিত্ব, জনমোহিনী শক্তি ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তাঁর চরিত্রে নেতা ও অভিনেতার আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেছিল। তিনি মানুষের মনস্তত্ব বুঝে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জার্মান জাতিকে আকৃষ্ট করেন।
মূল্যায়ন: ঐতিহাসিক ই এইচ কার হিটলারের উত্থানকে 'নাৎসি বিপ্লব' এবং ঐতিহাসিক কে এস পিনসন এই উত্থানকে 'গণ-আন্দোলন' বলে অভিহিত করেছেন। আবার রুশ ঐতিহাসিক দানীল মেলনিকভ ও লিউদমিলা চেরনাইয়া হিটলারকে 'বিশ্বের পয়লা নম্বর অপরাধী' বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য একথাও সত্য যে, হিটলার অবৈধ উপায়ে নয়, নির্বাচনে জয় লাভ করে সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতা দখল করেন।