জীবসত্তা ও মানবসত্তা
রবীন্দ্রনাথ তাঁর দার্শনিক চিন্তনে মানবতাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে দুটি সত্তাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই দুটি সত্তার একটি হল জীবসত্তা এবং অপরটি হল মানবসত্তা। তিনি তাঁর 'মানুষের ধর্ম' নামক প্রবন্ধে এই দুটি সত্তাকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
'জীবসত্তা'-র ধারণা: রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন যে, মানুষ জীবরূপে বাঁচতে চায় তার বিভিন্নপ্রকার জৈবিক কামনা-বাসনা নিয়ে। মানুষের জীবসত্তা তাই তার ব্যাবহারিক কামনা-বাসনা এবং স্বার্থসিদ্ধিকেই সূচিত করে। অর্থাৎ, স্বার্থ জড়িত কামনা-বাসনাই হল তার জীবসত্তা।
'মানবসত্তা'-র ধারণা: জীবসত্তাই কিন্তু মানুষের একমাত্র পরিচায়ক নয়। এই জীবসত্তার বাইরেও মানুষের একটা দুর্লভ পরিচয় আছে-যার
মাধ্যমে মানুষের মধ্যে জন্ম লাভ করে 'মনুষ্যত্ববোধ'। মানুষ তাই শুধুমাত্র তার জীবসত্তা নিয়েই বাঁচতে চায় না, সে বাঁচতে চায় তার অনেক বড়ো ও মহান
পরিচয় নিয়ে। আর এই অনেক বড়ো পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষাই তার উত্তরণ ঘটায় মানবসত্তায়—যার প্রকাশ ঘটে মানবতাবাদের মাধ্যমে। মানুষের এই
মানবসত্তাই মানুষের স্বার্থের বন্ধন শিথিল করে এবং আত্মত্যাগ ও আত্মোপলব্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে।
রবীন্দ্রনাথের মতে জীবসত্তা ও মানসত্তার পার্থক্য
রবীন্দ্রনাথের মতে জীবসত্তা ও মানবসত্তার পার্থক্যগুলি হল-
[I] স্বার্থযুক্ত জীবসত্তা, মনুষ্যত্বযুক্ত মানবসত্তা: রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'মানুষের ধর্ম' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, 'স্বার্থ আমাদের যেসব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি মানুষের জীবপ্রকৃতিতে, আর যা আমাদের ত্যাগের দিকে তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।' অর্থাৎ, স্বার্থসমন্বিত যে মানুষ, তা হল তার জীবসত্তার প্রকাশ। অপরদিকে, স্বার্থের গণ্ডির বাইরে মনুষ্যত্বের তপস্যারত যে মানুষ, তা হল তার মানবসত্তার প্রকাশ।
[ii] নশ্বর জীবসত্তা, অবিনশ্বর মানবসত্তা: মানুষের জীবসত্তার সমাপ্তি ঘটে তার মৃত্যুতে। কিন্তু মানুষের মানবসত্তার কোনো মৃত্যু নেই। মানুষের জীবসত্তা হল ক্ষণস্থায়ী এবং জন্মমৃত্যুর অধীন। কিন্তু মানবসত্তার কোনো জন্মমৃত্যু নেই, এ হল অমলিন ও শাশ্বত। মানুষের প্রকৃত মূল্যবোধ থেকেই মানবসত্তার উদ্বোধন ঘটে। সেকারণেই মানবসত্তা মানুষের সর্বোচ্চ আদর্শ হিসেবে গণ্য।
[iii] সসীমের প্রকাশক জীবসত্তা, অসীমের প্রকাশক মানবসত্তা:
রবীন্দ্রনাথের মতে, মানুষের জীবসত্তা তার সসীম দিকের প্রকাশকরূপে গণ্য। কারণ, এরূপ সত্তা একটি নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ এবং এর বাইরে তা আর এক- পাও এগিয়ে যেতে পারে না। জীবসত্তা নিজেকে নিয়ে নিজেই মত্ত। এ যেন ডিমের ভিতরে পক্ষীশাবকের অবস্থানের মতো। কিন্তু মানবসত্তা হল অসীমের প্রকাশক। কারণ, এরূপ সত্তা নিয়েই মানুষ বহির্মুখী হয়ে অসীমের দিকে এগিয়ে যায়। নিজের সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করে, মানবতার নজির নিয়ে বিশ্বমানবের দরবারে হাজির হয়। এভাবেই মানবসত্তা সমস্ত মানুষকে ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ করে ঊর্ধ্বমুখী করে।