কারণের স্বরূপ
কারণ হল এমনই এক ঘটনা, যার জন্য অন্য কোনো একটি ঘটনা ঘটে। 'ক' যদি 'খ'-এর কারণ হয়, তবে 'ক' নামক ঘটনাটি 'খ' নামক ঘটনাকে ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বৃষ্টিপাত হল মাটি ভেজার কারণ, ধোঁয়া হল আগুনের কারণ ইত্যাদি। কারণ যা কিছু ঘটায়, তাকেই বলা হয় কার্য। অর্থাৎ, পার্থিব জগতে যা কিছুই ঘটে, তাকেই বলা হয় কার্য। 'ক' যদি 'খ'-কে ঘটায়, তাহলে 'খ' হল কার্য। যেমন-আমরা বলতে পারি যে, মাটি ভেজা বৃষ্টিপাতের কার্য, দহন হল আগুনের কার্য ইত্যাদি।
কার্য-কারণ বিবয়ে দার্শনিক মতবাদ কার্য-কারণ সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ লক্ষ করা যায়। যেমন- [1] লৌকিক মতবাদ [2] বৈজ্ঞানিক মতবাদ [3] বুদ্ধিবাদীদের প্রসক্তি সম্বন্ধবাদ এবং [4] অভিজ্ঞতাবাদী হিউমের সতত সংযোগবাদ।
[1] লৌকিক মতবাদ: কার্যকারণ সম্বন্ধ বিষয়ে সাধারণ বা লৌকিক মত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কার্যকারণ সম্বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই মূলত এরূপ মতবাদটি গড়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় পাওয়া লৌকিক বিশ্বাসই হল এরূপ মতবাদের মৌল ভিত্তি। সে কারণেই কার্যকারণ সম্পর্কিত সাধারণ মানুষের মতবাদকে লৌকিক মতবাদরূপে গণ্য করা হয়।
[2] বৈজ্ঞানিক মতবাদ: কার্যকারণ সম্পর্ক বিষয়ে বৈজ্ঞানিক মতবাদে
কারণকে শক্তি হিসেবে দেখা হয়। বৈজ্ঞানিকরা শক্তির অবিনশ্বরতা নীতির উপর ভরসা রেখে বলেন-কার্যকারণের উপর কেবল গুণগত পার্থক্য রয়েছে, পরিমাণগত কোনো পার্থক্য নেই। যখন কারণশক্তি কার্যশক্তিতে রূপান্তরিত হয়, তখন কারণশক্তির একটি নতুন রূপ হল কার্য। তাই বলা যায় কার্যকারণ সম্পর্ক হল সার্বিক এবং অনিবার্য।
[3] বুদ্ধিবাদীদের প্রসক্তি সম্বন্ধবাদ:
কার্যকারণ সম্পর্কে বুদ্ধিবাদীদের অভিমতকে আবশ্যিক বা অবশ্যম্ভব মতবাদরূপে উল্লেখ করা হয়। এরূপ অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে যে, কার্যের ধারণাটি অনিবার্য বা আবশ্যিকভাবে কারণের ধারণা থেকে নিঃসৃত হয়। অর্থাৎ, কারণ ও কার্যের মধ্যে একপ্রকার আবশ্যিকতার সম্পর্ক আছে। কারণ ও কার্যের মধ্যে এই আবশ্যিকতার সম্বন্ধটি কীরূপ তা বোঝাতে গিয়েই প্রখ্যাত বুদ্ধিবাদী দার্শনিক ইউয়িং কার্যকারণের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে প্রসক্তি সম্বন্ধের
বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন।
[4] অভিজ্ঞতাবাদী হিউমের সতত সংযোগবাদ:
কার্যকারণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের বিপরীত এক মতবাদ প্রচার করেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম। বুদ্ধিবাদীদের মতে, কারণ ও কার্যের মধ্যে একপ্রকার অনিবার্যতার সম্বন্ধ থাকে। কিন্তু অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক ডেভিড হিউম বুদ্ধিবাদীদের এরূপ অভিমতটিকে নস্যাৎ করেছেন। তাঁর মতে, কার্য ও কারণের ধারণাটি আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ দুটি ধারণার বা ঘটনার অন্তঃস্থিত এক নিয়ত বা সততসংযোগের ধারণা মাত্র। কার্যকারণের ধারণাটি এর অতিরিক্ত কোনো ধারণা নয়। তাই কার্যকারণ সম্পর্কিত | হিউমের মতবাদ সতত সংযোগ তত্ত্ব নামে খ্যাত।