কার্যকারণ সম্পর্কিত হিউমের মতবাদ
কার্যকারণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের বিপরীত এক মতবাদ প্রচার করেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম। বুদ্ধিবাদীদের মতে, কারণ ও কার্যের মধ্যে একপ্রকার অনিবার্যতার সম্বন্ধ থাকে। কিন্তু অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক ডেভিড হিউম বুদ্ধিবাদীদের এরূপ অভিমতটিকে নস্যাৎ করেছেন। তাঁর মতে, কার্য ও কারণের ধারণাটি আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ দুটি ধারণার বা ঘটনার অন্তঃস্থিত এক নিয়ত বা সততসংযোগের ধারণা মাত্র। কার্যকারণের ধারণাটি এর অতিরিক্ত কোনো ধারণা নয়। তাই কার্যকারণ সম্পর্কিত হিউমের মতবাদ সতত সংযোগ তত্ত্ব নামে খ্যাত।
মূলকথা: হিউমের কার্যকারণ ধারণার ক্ষেত্রে মূলত দুটি দিক লক্ষ করা যায়। প্রথম দিকটিতে তিনি বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের অনিবার্য সম্বন্ধ মতবাদ তথা প্রসক্তি মতবাদকে নস্যাৎ করেছেন। আর দ্বিতীয় দিকটিতে তিনি তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। কার্যকারণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর এই প্রথম দিকটিকে নঞর্থক দিকরূপে উল্লেখ করা যায়, আর দ্বিতীয় দিকটিকে তাঁর সদর্থক দিকরূপে অভিহিত করা যায়।
হিউমের কার্যকারণ তত্ত্বের প্রথম বা নঞর্থক দিক:
ডেভিড হিউম প্রথমেই কার্য সম্পর্কিত বুদ্ধিবাদীদের অনিবার্য সম্বন্ধ মতবাদকে অগ্রাহ্য করেছেন। সে কারণেই এই দিকটিকে কার্যকারণ তত্ত্বের নঞর্থক দিকরূপে উল্লেখ করা হয়। কার্য ও কারণের মধ্যে কোনোপ্রকার আবশ্যিকতার বা প্রসক্তিতার সম্বন্ধ নেই-এই তত্ত্বের সপক্ষে হিউম যেসকল যুক্তির উপস্থাপনা করেছেন, সেইগুলি হল-
i. জানার উৎস হিসেবে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা:
হিউমের মতে, বুদ্ধিবাদীরা কার্যকারণের ক্ষেত্রে যে আবশ্যিকতার সম্বন্ধ উল্লেখ করেছেন, তা কখনোই আমাদের অভিজ্ঞতায় পাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর মতে, একমাত্র ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাই হল আমাদের সমস্তপ্রকার জ্ঞানের মৌল উৎস। তাই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় যা পাওয়া যায়, তা-ই হল সত্য, আর যা পাওয়া যায় না, তা-ই হল মিথ্যা। তিনি দাবি করেন যে, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় আমরা কারণ ও কার্যের বিষয়কে লাভ করতে সমর্থ হলেও, তাদের অন্তঃস্থিত আবশ্যিক সম্বন্ধকে লাভ করতে পারি না। অর্থাৎ, ইন্দ্রিয় সংবেদনের মাধ্যমে আমাদের কখনোই আবশ্যিক সম্বন্ধের জ্ঞান হয় না। সুতরাং, আবশ্যিক সম্বন্ধ বলে কিছুই নেই।
ii . কারণের শক্তি তত্ত্বের অসারতা:
সাধারণ লোক, বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবাদীরা দাবি করেন যে, কারণ হল এক শক্তি-বিশেষ যা কার্যকে উৎপন্ন করে। অর্থাৎ, কারণের শক্তির প্রকাশই হল তার কার্য। কিন্তু হিউম এরূপ অভিমতকে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, কারণের মধ্যে এমন কোনো শক্তির উপস্থিতি আমরা আদৌ অনুভব করি না। সুতরাং, কারণের মধ্যে কোনো শক্তিই নেই যা অনিবার্যভাবে কার্যকে ঘটায়।
iii.অনিবার্য সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থতা:
হিউমের মতে, কার্য ও কারণের সম্বন্ধ যে আবশ্যিক, তা বুদ্ধির দ্বারা পাওয়া যায় না। কারণ, তা যদি হত, তাহলে কার্যকারণের সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞান অবশ্যই বিশ্লেষকরূপে গণ্য হত। অর্থাৎ, কারণকে বিশ্লেষণ করলে কার্যটি পাওয়া সম্ভব হত। কিন্তু তা কখনোই হয় না। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি জলপান হল তৃয়া নিবারণের কারণ। কিন্তু জলকে বিশ্লেষণ করলে কখনোই তৃয়া নিবারণের ধারণাটি পাওয়া যায় না।
কার্যকারণ তত্ত্বের দ্বিতীয় বা সদর্থক দিক
ডেভিড হিউম কার্যকরণ তত্ত্বের সপক্ষে সদর্থক দিক রূপে যে যুক্তিগুলির উপস্থাপনা করেছেন তা হল-
নিয়মিত পৌর্বাপর্যের দিক: হিউম দাবি করেন যে, কার্য ও কারণ হল দুটি পরস্পরবিচ্ছিন্ন ঘটনা। এদের মধ্যে কোনোপ্রকার আবশ্যিক সম্বন্ধই নেই। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় শুধু লক্ষ করি যে, কারণ নামক ঘটনাটি আগে ঘটে এবং কার্য নামক ঘটনাটি পরে ঘটে। কারণ হল কার্যের নিয়ত পূর্ববর্তী ঘটনা এবং কার্য হল তার অনুগামী। এর মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম আমরা দেখি না। এভাবেই দুটি ঘটনার একটিকে আর-একটির পর বারবার ঘটতে দেখে আমাদের মনে এইপ্রকার মানসিক প্রবণতার সৃষ্টি হয় যে, একটি ঘটলে অপরটিও ঘটবে। কার্যকারণের ক্ষেত্রে এরূপ মানসিক প্রত্যাশাই আমরা করে থাকি। এর ফলে কার্যকারণ সম্বন্ধের বিষয়টি আমাদের কাছে একপ্রকার মানসিক ঝোঁকে পরিণত হয়। কারণ ও কার্যের মধ্যে তাই কোনোপ্রকার আবশ্যিক বা অনিবার্য সম্পর্ক নেই, যা আছে তা হল দুটি ঘটনার মধ্যে সতত সংযোগ বা নিয়মিত পৌর্বাপর্য (continuous succession)।
হিউমের বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা
কার্যকারণ সম্পর্কিত হিউমের মতবাদও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, দুটি ঘটনার মধ্যে নিয়মিত পৌর্বাপর্য বা সতত সংযোগ থাকলেই যে তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকবে—এমন দাবি করা আদৌ সংগত নয়। আবার, হিউমের মতবাদটিকে যদি সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে হয় যে, যেহেতু দিন ও রাত পরপর ঘটে, সেহেতু এই দুটি ঘটনাও কার্যকারণ সম্বন্ধে আবদ্ধ। কিন্তু দিন ও রাত কোনোটিই কারও কারণ বা কার্য নয়। এই দুটি ঘটনাই হল অন্য একটি সার্বিক ঘটনা থেকে নিঃসৃত। এই দুটি ঘটনা তাই সহকার্যের সম্বন্ধে আবদ্ধ; কখনোই কার্যকারণ সম্বন্ধে আবদ্ধ নয়। সুতরাং, কার্যকারণ সম্পর্কিত হিউমের মতবাদটি কখনোই গ্রহণীয় হতে পারে না।