ধর্মের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
ব্যুৎপত্তিগত অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় যে, ধর্ম শব্দটি ধূ ধাতুর ওপর মন প্রত্যয় যোগ করে উৎপন্ন হয়েছে। ধূ ধাতুর অর্থ হল যা মানুষকে ধারণ করে। সুতরাং, যা মানুষকে ধারণ করে তাই হল ধর্ম। এই ধারণ কিন্তু শুধু কোনো বাহ্যিক ধারণ নয়, এ অন্তরের ধারণকেও বোঝায়। অর্থাৎ, মানুষের বাহ্যরূপ ও আন্তররূপ—এই দুইয়ের পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যতার মধ্য দিয়ে যা মানুষের জীবনকে ধরে রাখে এবং মানবসত্তাকে নির্দেশ করে, তাকেই বলা হয় ধর্ম।
মানুষের জীবনে ধর্মের প্রভাব
মানুষের জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মানুষের জীবনে ধর্মের ব্যাপারটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, এমন কোনো মানবগোষ্ঠী আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি, যেখানে ধর্মের কোনো ভূমিকাই নেই। মানুষের জীবনে ধর্ম তাই এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়রূপেই গণ্য হয়। সৃষ্টির আদি যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যত মানবগোষ্ঠীরই উত্থান-পতন হোক-না-কেন, সমাজের যতই পরিবর্তন হোক-না-কেন, এ কথা যথার্থ যে প্রত্যেকটি সমাজে, প্রত্যেকটি মানুষের মনে ধর্মের একটা প্রভাব আছে। ধর্ম তাই ভালো ও খারাপ দু-দিক দিয়েই মানুষকে বেঁধে রেখেছে, যাকে অতিক্রম করা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। অবশ্য এ কথা সত্য যে, বিভিন্ন সমাজে ধর্মের অর্থ ও প্রকৃতি কখনোই এক নয়। বিভিন্ন সমাজে তাই ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন রূপ লক্ষ করা যায়। সেকারণে মনুষ্যজাতি সম্পর্কে জানতে গেলে, তার ধর্মের দিকটিকেও জানতে হয়। ম্যাক্সমুলার (Maxmuller)-কে অনুসরণ করে তাই বলা যায় যে, মানুষের প্রকৃত ইতিহাস হল ধর্মের ইতিহাস।
রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্ম
রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্ম কী-তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
[1] পূর্ণতা প্রদানই ধর্মের প্রকৃত অর্থ: ধর্ম সর্বোচ্চ শুদ্ধ নৈতিক সত্তার প্রতি অনুরাগকে সূচিত করে। ধর্মের তাৎপর্য তাই অত্যন্ত ব্যাপক। ধর্ম কোনো দেশে, কালে এবং সমাজে আবদ্ধ থাকতে পারে না। ধর্ম মানবীয় সত্তা হিসেবে মানুষকে পূর্ণতা প্রদান করে। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রমুখ মনীষীগণ তাই ধর্ম বলতে 'মানবধর্ম'-কেই বুঝিয়েছেন।
[2] মানবতাবাদই একমাত্র ধর্ম: রবীন্দ্রনাথের কাছে মানবধর্মের অর্থ হল মানবতাবাদ। রবীন্দ্রনাথই হলেন প্রথম চিন্তানায়ক যিনি মানবতাবাদকে মানুষের প্রকৃত ধর্ম হওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর আগে অনেকেই মানবতাবাদের কথা বললেও, মানবতা যে সব মানুষেরই একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত-তা বোধহয় রবীন্দ্রনাথের আগে কেউই বলেননি। ধর্ম বলতে রবীন্দ্রনাথ তাই মানবতাকেই সূচিত করেছেন। তিনি তাঁর 'মানুষের ধর্ম' প্রবন্ধে এবং 'Religion of Man' গ্রন্থে অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠভাবে মানবতাকে মানুষের ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
[3] আত্মোপলব্ধির সহায়করূপে ধর্ম: ধর্মই মানুষকে মানবসত্তার সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠা করে এবং আত্মত্যাগ ও আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করে। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, ধর্ম নেই কোনো মন্দিরে, মসজিদে অথবা গির্জায়; আছে শুধু মানুষেরই অন্তরে। ধর্ম মানুষের মনে মানবতার দ্বারকে উন্মুক্ত করে তাকে হাজির করে বিশ্বচেতনায়। এ যেন চণ্ডীদাসের 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই' বাণীরই প্রতিধ্বনি। ধর্ম হিসেবে মানবতাবাদ তাই অবশ্যই সাবেকি ধর্মচেতনা থেকে স্বতন্ত্র এবং মানব চেতনায় উদ্বুদ্ধ।