মানুষের সীমাবদ্ধতার দিক তথা সসীম সত্তার দিক
মানুষের সীমাবদ্ধতার দিক তথা সসীম সত্তার ধারণাগুলিকে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা যায়:
[1] দৈহিক ও আধ্যাত্মিক প্রকৃতিতে মানুষ: রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে আমরা মানবপ্রকৃতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা লক্ষ করি। এই দুটি প্রকৃতির একটি হল মানুষের দৈহিক প্রকৃতি এবং অন্যটি হল মানুষের আধ্যাত্মিক প্রকৃতি। মানুষ তার দৈহিক প্রকৃতি লাভ করেছে জৈবিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু মানুষ তার আধ্যাত্মিক প্রকৃতি লাভ করেছে তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। মানুষের দৈহিক প্রকৃতিতেই নিহিত আছে তার সসীম সত্তার দিকটি। মানুষ তার দৈহিক প্রকৃতির মাধ্যমে কিছু সীমাবদ্ধ অবস্থায় আবর্তিত হয়। মানুষের এই সীমাবদ্ধ অবস্থাই তার সীমাবদ্ধতার দিকটিকে তথা সসীম সত্তার দিকটিকে প্রকাশ করে।
[2] স্বার্থ সম্বলিত মানবসত্তাই সসীম সত্তা: মানুষ হল মূলত প্রাণীজগতের অংশীদার। অর্থাৎ, মানুষ প্রথমে একটি জীব বা প্রাণী হিসেবেই গণ্য হয়। একটি জীব বা প্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য তাকে অহরহ বিভিন্ন বিষয়ে সংগ্রাম করতে হয়। সংগ্রামরত দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপটে মানুষ তখন তার স্বার্থ সম্বলিত ক্রিয়াকলাপের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই স্বার্থের গণ্ডির বাইরে মানুষ তাই আর-এক পাও এগিয়ে যেতে পারে না। স্বার্থের সীমানায় আবদ্ধ হয়ে পড়াই হল মানুষের সসীম সত্তার দিক। এরুপ সত্তার পরিপ্রেক্ষিতেই মানুষ অন্যান্য পশুর মতোই আচরণ করে। পশুর মতো মানুষও তখন তার কামনা-বাসনা পরিতৃপ্তির জন্য জৈবিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এটিই মানবচরিত্রের সসীম সত্তা তথা সীমাবদ্ধতার দিক।
[3] প্রকৃতির কাছে মানুষের সসীম সত্তা: মানুষ মূলত জীব বা প্রাণীকুলের অংশীদার হলেও, মানুষের মধ্যে কতকগুলি প্রকৃতিগত ও অর্জিত গুণ আছে। এই গুণগুলি মানুষকে অন্যান্য নিম্ন শ্রেণির জীব থেকে আলাদা করেছে। এই গুণগুলির অন্যতম হল মানুষের বুদ্ধিমত্তা। এই বুদ্ধিমত্তাই মানুষকে প্রাণীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান দিয়েছে। অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তাদের ইন্দ্রিয়বৃত্তির ক্ষেত্রে কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ নেই।
কিন্তু মানুষ তার স্বীয় বুদ্ধিমত্তার ফলে তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর ফলে কখন, কোথায়, কোন্ ধরনের কাজ করা উচিত তা সে স্থির করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। কারণ, এমন কিছু প্রাকৃতিক ক্ষেত্র আছে যেখানে মানুষ অসহায়ভাবে প্রকৃতির হাতে নিজেকে সঁপে দেয়। আপন বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করেও মানুষ কখনোই এরকম প্রাকৃতিক ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।
[4] সীমার মধ্যেও অসীমের প্রকাশ: মানুষের এরূপ সীমাবদ্ধতা তথা সসীমতার মধ্যেই তার আধ্যাত্মিক দিকটির সম্ভাবনা ফুটে ওঠে। মানুষের প্রকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধতার দিকটি থাকলেও, এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে অবস্থান করেই মানবাত্মা অসীমকে ছুঁতে চায়। এই আধ্যাত্মিক চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা তাকে সসীমতার বৃত্তের বাইরে টেনে নিয়ে যায়। মানুষের এরূপ আধ্যাত্মিক চেতনার ফলেই মানুষের মন অহংভাব ত্যাগ করতে সমর্থ হয় এবং অসীমের দিকে যাত্রা করে।