মার্কিন রাষ্ট্রপতি হারবার্ট ক্লার্ক হুভারের (১৯২৯-৩৩ খ্রি.) আমলে দেশে অর্থনৈতিক মহামন্দা দেখা দিলে আমেরিকা তথা বিশ্ব-অর্থনীতিতে তীব্র সংকট দেখা দেয়। এই অবস্থায় হুভারের পতন ঘটে এবং নির্বাচনে জয় লাভ করে ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হন।
রুজভেল্টের 'নতুন ব্যবস্থা'
রুজভেল্ট তাঁর 'নতুন ব্যবস্থা' বা 'নিউ ডিল'-এর মাধ্যমে আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা দূর করার চেষ্টা করেন।
[1] 'নিউ ডিল' কী?: রুজভেল্টের পরামর্শদাতা রেমন্ড চার্লস মোলে 'নিউ ডিল' কথাটি নির্বাচন করেন এবং রুজভেল্ট তাঁর নির্বাচনি প্রচারে কথাটি জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি 'নিউ ডিল' বা 'নতুন ব্যবস্থা' বলতে আমেরিকার বেকার সমস্যার সমাধান, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাংক প্রভৃতি ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপকে বুঝিয়েছেন।
[2] উদ্দেশ্য: রুজভেল্ট 'নতুন ব্যবস্থার' উদ্দেশ্যগুলি ছিল-[i] গণতন্ত্র রক্ষার মাধ্যমে আমেরিকাবাসীর কল্যাণ সাধন। [ii] আমেরিকার অন্নহীন, গৃহহীন দরিদ্র মানুষকে সাহায্য দান। [ii] অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করে পুনরায় মার্কিন অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটানো। [iv] সংস্কারের মাধ্যমে দুর্বলতা দূর করে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশকে রক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রভৃতি।
[3] বাস্তবায়ন: নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে রুজভেল্ট বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন-[i] তিনি পূর্বতন রিপাবলিকান সরকারের অবাধ বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন ঘটান। [ii] দেশবাসী যাতে ব্যাংকে টাকা জমা রাখার সাহস পায় সে উদ্দেশ্যে সরকার সাময়িকভাবে ব্যাংকগুলির পরিচালনার দায়িত্ব ও ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের গ্যারান্টি নেয়। [iii] দ্য সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন করে শেয়ার, বন্ড ও সিকিউরিটির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ চাপানো হয়। [iv] কৃষক ত্রাণ আইন (১৯৩৩ খ্রি.)-এর সাহায্যে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেয়। কৃষকরা তাদের পণ্যের সঠিক মূল্য পেতে শুরু করে।
[v] বেকার সমস্যা দূর করার উদ্দেশ্যে সিভিলিয়ান কনজারভেশন কর্পস নামে একটি সংস্থা গঠন করে এর মাধ্যমে গ্রামগঞ্জের প্রচুর বেকার যুবককে নির্মাণকার্যে নিয়োগ করা হয়। [vi] জাতীয় শিল্প পুনঃপ্রতিষ্ঠা আইন (১৯৩৩ খ্রি.)-এর মাধ্যমে শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হয়। [vii] অসহায়দের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে দ্য ফেডারেল এমারজেন্সি রিলিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে এক সংস্থার অধীনে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গড়া হয়।
[4] ত্রুটি: রুজভেল্টের 'নতুন ব্যবস্থা'র কয়েকটি ত্রুটি লক্ষ করা যায়। যেমন- [1] 'নতুন ব্যবস্থা'র দ্বারা বেকার সমস্যার সমাধান এবং উৎপাদন ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয় তা সফল হয়নি। [Ⅱ] ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের বাইরে অন্যান্য শিল্পের বিকাশ আশানুরুপ ঘটেনি। [iii] শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন, শ্রমিকদের মজুরি ও কাজের সময় নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে 'নতুন ব্যবস্থা'য় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ হয়।
[5] সাফল্য: কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও 'নতুন ব্যবস্থা' বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছিল।-[i] এই ব্যবস্থা মার্কিন অর্থনৈতিক মন্দা দূর করতে অনেকটা সফল হয়। [ii] দারিদ্র ও বেকারত্ব যথেষ্ট হ্রাস পায়। [iii] শ্রমিকদের কাজের সর্বোচ্চ সময়সীমা ৮ ঘণ্টা বেঁধে দেওয়া হয়। [iv] শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারিত হয়। [v] শিশুশ্রমিক নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়। [vi] দেশে অসংখ্য নতুন রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতাল প্রভৃতি নির্মিত হয়। [vii] কৃষির উন্নতির উদ্দেশ্যে জলাধার তৈরি, সেচ প্রকল্প, বন্যা প্রতিরোধ প্রভৃতি উদ্যোগ নেওয়া হয়।
মূল্যায়ন: মার্কিন ঐতিহাসিক রিচার্ড হফস্টাডটার বলেছেন যে, "মার্কিন রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নিউ ডিল একটি নতুন বিচ্যুতি।" কিন্তু বহু অর্থনীতিবিদ এই বক্তব্য মানতে নারাজ। তাদের মতে, রুজভেল্টের 'নিউ ডিল' মার্কিন অর্থনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। আমেরিকা যখন অর্থনৈতিক সংকটে দিশেহারা তখন বুজভেল্টের 'নিউ ডিল'-এর কর্মসূচির দ্বারা দেশ ঘুরে দাঁড়ায়।