নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ
নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, নিষ্প্রকারকংজ্ঞানম্ নির্বিকল্পকম্। অর্থাৎ যে প্রত্যক্ষ প্রকার বা বিশেষণশূন্য তাকেই বলা হয় নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ। নিঃ + বিকল্প = নির্বিকল্পকম্। 'নিঃ' শব্দের অর্থ হল নাই, আর 'বিকল্প' শব্দের অর্থ হল বিশেষণ। সুতরাং, যে প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে বিষয়ের কোনো বিশেষণ নেই, তাই হল নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ।
নিছক অস্তিত্বের প্রত্যক্ষরূপে নির্বিকল্পক: নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যক্ষের মাধ্যমে কেবল বস্তুর অস্তিত্বকেই জানতে পারি, তার কোনো প্রকার বা গুণধর্মকে নয়। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে তাই বস্তুর প্রকার তথা নাম, জাতি, স্বরূপ সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণাই হয় না। এ হল বস্তুর একপ্রকার অস্তিত্বমূলক সাধারণ উপলব্ধি, বস্তুর স্বরূপগত কোনো উপলব্ধি নয়।
বচনে অপ্রকাশযোগ্যরূপে নির্বিকল্পক: নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে বস্তুর প্রত্যক্ষ হয় ঠিকই, কিন্তু বস্তুর স্বরূপগত প্রত্যক্ষ না হওয়াতে তাকে কখনোই বাচনিক আকারে প্রকাশ করা যায় না। একারণেই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকে অব্যাপ্যদেশ্যরূপে উল্লেখ করা হয়। 'অব্যাপ্যদেশ্য' শব্দটির অর্থ হল বচনে অপ্রকাশযোগ্য। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ তাই ব্যবসায়াত্মক বা নিশ্চিত জ্ঞান নয়। এরূপ প্রত্যক্ষ তাই সবসময়ই অনিশ্চিত। যেমন, আলো-আঁধারে কোনো একটি বস্তুকে দেখে মানুষ না গাছের কাণ্ড বুঝতে না পারা। অর্থাৎ, একটা কিছুকে প্রত্যক্ষ করা হলেও ঠিক কী প্রত্যক্ষ করা হয়-তা বলা যায় না।
নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকে মেনে নেওয়ার কারণ
নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হল বিশেষণবর্জিত এক নিছক প্রত্যক্ষ। এরূপ প্রত্যক্ষে কেবল বস্তুর অস্তিত্বেরই জ্ঞান হয়, বস্তুর স্বরূপের কোনো জ্ঞান হয় না। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন ওঠে যে-নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকে স্বীকার করার সপক্ষে যুক্তি কী? নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকে স্বীকার করার সপক্ষে নৈয়ায়িকগণ অত্যন্ত জোরালোভাবে সওয়াল করেছেন। এই যুক্তিগুলি হল-
[1] প্রাথমিক প্রত্যক্ষরূপে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ: নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হল প্রথম প্রত্যক্ষ। অর্থাৎ, যে-কোনো বস্তুর প্রাথমিক প্রত্যক্ষরূপে নির্বিকল্পককের বিষয়টিকে স্বীকার করে নিতে হয়। প্রত্যক্ষকে যদি প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করতেই হয়, তাহলে প্রত্যক্ষ হিসেবে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকেও স্বীকার করে নেওয়া সংগত।
[2] সবিকল্পক প্রত্যক্ষের ভিত্তিরূপে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ:
নৈয়ায়িকগণ দাবি করেছেন যে, সবিকল্পক প্রত্যক্ষের উৎস বা ভিত্তি হল নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ। প্রাথমিকভাবে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের বিষয়টি উদ্ভূত না হলে, পরিণত প্রত্যক্ষরূপে সবিকল্পক প্রত্যক্ষের বিষয়টি কখনোই সম্ভব নয়। সুতরাং, সবিকল্পক প্রত্যক্ষকে যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে তার ভিত্তিরূপে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকে স্বীকার করে নিতেই হয়।
[3] অবিশিষ্ট প্রত্যক্ষরূপে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ: ন্যায়দর্শনে বিশিষ্ট জ্ঞান তথা বিশিষ্ট প্রত্যক্ষের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এটা একটা ঘট-এ হল একটি বিশিষ্ট জ্ঞান। কারণ এক্ষেত্রে ঘটটিকে ঘটত্ব বিশিষ্টরূপে জানা হয়। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে ঘটের জ্ঞান হওয়ার আগেই ঘটত্বের জ্ঞান উৎপন্ন হয়। আর বিশিষ্ট জ্ঞান মাত্রেই যদি বিশেষণের জ্ঞানের ওপর নির্ভর করতে হয়, তাহলেই সেই বিশেষণের আবার অন্য কোনো বিশেষণ থাকতে হয়। এভাবেই যদি ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাওয়া যায় তাহলে অনবস্থা দোষের উদ্ভব ঘটে। এই অনবস্থা দোষটি পরিহারের জন্যই অবিশিষ্ট প্রত্যক্ষরূপে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকে স্বীকার করা উচিত।