ন্যায়দর্শন মতে আত্মা
ন্যায়দর্শনে আত্মাকে দ্বাদশ প্রমেয় পদার্থের প্রথম পদার্থরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যায় মতে, আত্মা দ্বিবিধㅡ[1] জীবাত্মা এবং [2] পরমাত্মা। জীবাত্মা অল্পজ্ঞ এবং অনেক, কিন্তু পরমাত্মা সর্বজ্ঞ ও এক ঈশ্বর। অপরাপর ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলির ন্যায়, ন্যায়দর্শনেও জীবাত্মা এবং তার মুক্তিবিধানের উল্লেখ করা হয়েছে।
আত্মার স্বরূপ
ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে জীবাত্মার স্বরূপ: জীবাত্মার স্বরূপ সম্পর্কে ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন মত প্রচলিত হলেও, মূলত চারটি মতবাদ এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম মতবাদটি হল চার্বাক সম্প্রদায়ের জড়বাদী মতবাদ। চার্বাক মতে, চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হল আত্মা। এ ছাড়া আত্মার আর কোনো পরিচয় নেই। দেহের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে তাই আত্মাও ধ্বংস হয়। দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব তাই নিছক কল্পনা বা মিথ্যা মাত্র। দ্বিতীয় মতবাদটি হল বৌদ্ধদের অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ। অভিজ্ঞতাবাদী বৌদ্ধদের মতে, আত্মা পরিবর্তনশীল চেতনা প্রবাহ ছাড়া আর কিছুই নয়। বৌদ্ধ মতে, আত্মা হল পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টিমাত্র। প্রখ্যাত পাশ্চাত্য দার্শনিক ডেভিড হিউমও আত্মা সম্পর্কে অনুরূপ মত পোষণ করেছেন। সুতরাং, আত্মা সম্পর্কে বৌদ্ধদের সঙ্গে হিউমের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদের একপ্রকার মিল পরিলক্ষিত হয়। পরিবর্তনশীল মানসিক অবস্থাসমূহকেই হিউম আত্মারূপে উল্লেখ করেন। তৃতীয় মতবাদটি হল অদ্বৈত বেদান্তীদের মতবাদ যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আত্মা হল বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। এই বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বপ্রকাশ ও নিত্যরূপে গণ্য। অর্থাৎ, আত্মা জ্ঞাতারূপেও স্বীকার্য নয়, আবার তা জ্ঞেয়রূপেও স্বীকৃত নয়। চতুর্থ মতবাদটি হল বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের মতবাদ। রামানুজের মতে, আত্মা হল সগুণ, সচেতন ও সক্রিয় দ্রব্যস্বরূপ। চৈতন্যময় অহংরূপে এই আত্মা বিরাজমান। এরূপ আত্মা জ্ঞাতারূপে গণ্য। আত্মা সম্পর্কে উল্লিখিত এই চারটি মতবাদের মধ্যে শেষের দুটি মতবাদকে ভাববাদীরূপে উল্লেখ করা হয়।
আত্মা সম্পর্কে ন্যায় বৈশেষিকদের অভিমত: আত্মা সম্পর্কে ন্যায় বৈশেষিকরা একটি স্বতন্ত্র ও নিজস্ব মতবাদ উপস্থাপিত করেছেন। আত্মা সম্পর্কিত ন্যায় বৈশেষিক মতবাদকে বস্তুবাদী মতবাদরূপে উল্লেখ করা হয়। ন্যায়দার্শনিকদের মতে, আত্মা হল দ্রব্যস্বরূপ এবং চৈতন্য হল তার আগন্তুক গুণ। যখন আত্মা দেহের সঙ্গে, দেহ মনের সঙ্গে, মন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এবং ইন্দ্রিয় বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখনই আত্মায় চৈতন্য নামক আগন্তুক গুণের আবির্ভাব ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই আত্মা যখন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তখন তার চৈতন্য নামক গুণটিও অন্তর্হিত হয়। এক-একটি আত্মা এক-একটি বিশেষ বিশেষ দেহকে কেন্দ্র করে থাকে। এতদসত্ত্বেও ন্যায় বৈশেষিকরা দাবি করেন যে, আত্মা হল শাশ্বত ও সর্বব্যাপী। দেহ ও কাল দ্বারা আত্মা কখনোই সীমায়িত হতে পারে না। সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ এবং প্রযত্ন রূপ আত্মার মানসিক অবস্থাসমূহকে আমরা কখনোই বাহ্য ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করতে পারি না বলেই, আত্মাকে জড়দ্রব্যরূপে উল্লেখ করা যায় না। কারণ, এই সমস্ত গুণ কোনো জড়দ্রব্যের গুণ নয়। আত্মা তাই এক অভৌতিক তথা আধ্যাত্মিক দ্রব্যস্বরূপ।
চৈতন্যের আধাররূপে আত্মা: নৈয়ায়িকদের মতে, আত্মা দেহ থেকে ভিন্ন। চার্বাকপন্থীদের দেহাত্মবাদকে অস্বীকার করে নৈয়ায়িকগণ দাবি করেন যে, আত্মা এবং দেহ কখনোই অভিন্নরূপে গণ্য নয়। দেহ জন্মমৃত্যুর অধীন হলেও, আত্মা কিন্তু অজ অর্থাৎ এর কোনো জন্মমৃত্যু নেই। অধিষ্ঠান বা আধার ছাড়া চৈতন্য কখনোই থাকতে পারে না। সেকারণেই নৈয়ায়িকগণ আত্মা বলতে চৈতন্য গুণবিশিষ্ট একটি দ্রব্যকেই সূচিত করেছেন। ন্যায় মতে, আত্মা জ্ঞাতা, ভোক্তা এবং অহংবোধের আশ্রয়স্বরূপ।
স্মৃতি ও প্রত্যভিজ্ঞার ব্যাখ্যাকারীরূপে আত্মা: আত্মা বহিরিন্দ্রিয় থেকেও ভিন্ন। কারণ, বহিরিন্দ্রিয়গুলি ভৌতিকরূপে গণ্য, কিন্তু আত্মা অবশ্যই অভৌতিকরূপে স্বীকৃত। আত্মা তাই ইন্দ্রিয় থেকেও ভিন্ন। আত্মাকে আবার বৌদ্ধদের ন্যায় চেতনাপ্রবাহরূপে উল্লেখ করাও সংগত নয়। কারণ, আত্মাকে চেতনাপ্রবাহরূপে উল্লেখ করলে, স্মৃতি এবং প্রত্যভিজ্ঞার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। স্মৃতি এবং প্রত্যভিজ্ঞাকে ব্যাখ্যা করতে হলে অপরিবর্তনীয় আত্মাকে তাই স্বীকার করে নিতেই হয়।
নৈয়ায়িকদের মতে, আত্মা মন নয়। মন হল অন্তরিন্দ্রিয়, যার সাহায্যে আত্মা বিভিন্নপ্রকার মানবিক অবস্থাগুলিকে প্রত্যক্ষ করতে সমর্থ হয়। এই মন হল অতিসূক্ষ্ম এবং পারমাণবিক অবস্থা, যা দৃশ্যগোচর নয়। আত্মার সঙ্গে সংযোগ হলে তবেই আত্মাতে জ্ঞানের আবির্ভাব হয়। আত্মাকে তাই জ্ঞাতারূপে উল্লেখ করা সংগত এবং মন হল এই জ্ঞানলাভের উপায় মাত্র। আত্মাই মনকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং সেজন্যই মনকে আত্মার কারণরূপে দাবি করা হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে, আত্মা কী? এরূপ প্রশ্নের উত্তরে ন্যায় বৈশেষিকগণ বলেন যে, আত্মা এক সনাতন দ্রব্য। চৈতন্য আত্মার আকস্মিক গুণ।
শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত স্বভাব সম্পন্নরূপে আত্মার স্বরূপ: আত্মা স্বরূপত নির্গুণ ও নিষ্ক্রিয়, নিত্য, শুদ্ধ ও মুক্ত। অবিদ্যার প্রভাবেই আত্মার বন্ধনদশা সূচিত হয়। এরূপ বন্ধনযুক্ত আত্মাকেই জীব বলা হয়। বন্ধ অবস্থায় আত্মা নিজেকে জ্ঞাতা, কর্তা এবং ভোক্তা বলে মনে করে। এর ফলেই আত্মা নানাপ্রকার জাগতিক দুঃখকষ্টের মধ্যে নিমজ্জিত হয়। আত্মার বিবেকজ্ঞানের উদয় হলে তবেই দুঃখের আত্যন্তিক মুক্তি ঘটে। আত্মা নিরবয়ব এবং নিত্য, কারণ তা জীবের মৃত্যুর পূর্বেও ছিল, আবার পরেও থাকে। এরূপ আত্মা জীবাত্মারূপে উল্লেখিত এবং সংখ্যায় অসংখ্য।
কর্মফল অনুসারে আত্মার দেহ থেকে দেহান্তরে গমন: ন্যায় মতে, আত্মা বুদ্ধি, উপলব্ধি এবং জ্ঞান-এদের কোনোটিই নয়। কারণ, আত্মা স্থায়ী এবং নিত্য, কিন্তু বুদ্ধি বা জ্ঞান প্রভৃতি হল অস্থায়ী ও অনিত্য। বুদ্ধি বা জ্ঞান কখনোই আত্মার কর্ম নয়, বুদ্ধি বা জ্ঞান হল আত্মার গুণ মাত্র। আত্মা অবিনাশী এবং সে কারণেই এর কোনো বিনাশ নেই। কর্মফল অনুসারে আত্মা দেহ থেকে দেহান্তরে গমন করে। এরূপ আত্মা জীবাত্মারূপেই গণ্য। ন্যায় মতে, জীবাত্মা কোনো মনুষ্যেতর প্রাণীর দেহ ধারণ করে না। এই জীবাত্মার মুক্তিই হল ন্যায় দর্শনের মূল লক্ষ্য।