অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে বুরবোঁ বংশের নেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী এই রাজতন্ত্রে রাজা ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ শাসক, আইন প্রণয়নকারী এবং প্রধান বিচারক। শাসনব্যবস্থায় জনগণের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না।
ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক কারণ : রাজতন্ত্রের দায়িত্ব
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব সৃষ্টিতে রাজতন্ত্রের বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি ও রাজতন্ত্রের দায়িত্ব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
[1] রাজাদের দুর্বলতা: ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫ খ্রি.) ছিলেন চরম স্বৈরাচারী। তিনি বলতেন "আমিই রাষ্ট্র"। অলস ও বিলাসী রাজা পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-৭৪ খ্রি.) তাঁর উপপত্নী মাদাম দ্য পম্পাদুর- এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শাসন পরিচালনা করলে প্রশাসন দুর্নীতি ও
স্বজনপোষণে ছেয়ে যায়। এরপর অযোগ্য রাজা ষোড়শ লুই (১৭৭৪- ৯৩ খ্রি.) রাজতন্ত্রকে অবক্ষয়ের শেষ সীমায় নিয়ে যান।
[2] অভিজাতদের আধিপত্য: প্রশাসনে অভিজাত সম্প্রদায়ের আধিপত্য শাসনব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। প্রশাসন প্রচণ্ড দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ইনটেনডেন্ট' নামে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীরা খুবই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। অভিজাত রাজপুরুষরা 'লেতর দ্য ক্যাশে' নামে এক রাজকীয় পরোয়ানার দ্বারা যে-কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করে রাখার অধিকার পায়।
[3] ত্রুটিপূর্ণ আইন: অষ্টাদশ শতকে ফরাসি আইন ছিল অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ,
জটিল ও দুর্বোধ্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের আইন ও দণ্ডবিধি প্রচলিত ছিল। আইনগুলি ছিল অত্যন্ত নির্মম। সাধারণ অপরাধের জন্যও অনেকসময় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।
[4] বিচারব্যবস্থায় ত্রুটি: ফরাসি বিচারব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও দুর্নীতিগ্রস্ত। অধিকাংশ বিচারক ছিলেন অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ। অপরাধীদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ, জরিমানা আদায় প্রভৃতির দ্বারা দুর্নীতিপরায়ণ বিচারকরা বিপুল অর্থ উপার্জন করতেন।
[5] অমিতব্যয়িতা: ফরাসি রাজপরিবার ছিল সীমাহীন অমিতব্যয়ী।
রাজপরিবারের সেবাকার্যের উদ্দেশ্যে ভার্সাই রাজপ্রাসাদে ১৮ হাজার কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। রানি মারি আঁতোয়ানেতের ব্যক্তিগত কর্মচারীর সংখ্যাই ছিল ৫০০ জন। রাজপরিবারের অমিতব্যয়িতা দেশের অর্থসংকট তীব্রতর করলে দেশবাসীর মনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
[6] ত্রুটিপূর্ণ রাজস্বব্যবস্থা: ফ্রান্সের ৯৫ শতাংশ সম্পদ যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে থাকলেও এর জন্য তাদের কাছ থেকে কোনো কর আদায় করা হত না। ফলে যাবতীয় করের বোঝা বহন করতে হত দেশের মাত্র ৫ শতাংশ সম্পদের মালিক তৃতীয় সম্প্রদায়কে। রাজকীয় কর ছাড়াও সামন্তপ্রভু ও গির্জা তৃতীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করত।
[7] ষোড়শ লুই-এর ভূমিকা: দেশের অর্থনৈতিক সংকট অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠলে রাজা ষোড়শ লুই-এর উচিত ছিল যাজক ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকার খর্ব করে এবং তাদের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া। কিন্তু ষোড়শ লুই একাজে জোরালো পদক্ষেপ না নেওয়ায় জনগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়।
মূল্যায়ন: ফরাসি বিপ্লবের জন্য রাজতন্ত্রের দায়িত্বকে কোনোভাবে অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহাসিক ফিশার বিপ্লবের জন্য ফরাসি রাজতন্ত্রকে দায়ী করেছেন। ঐতিহাসিক মাদেলাঁ-ও বলেছেন যে, "ফরাসি রাজতন্ত্রই বিপ্লব সৃষ্টি করেছে।"