প্রতিরুপী বস্তুবাদের গ্রহণযোগ্যতা
সরল বস্তুবাদের দোষ-ত্রুটি দূর করার জন্যই প্রতিরূপী বস্তুবাদের প্রবর্তন হয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে প্রতিরূপী বস্তুবাদ বহুলাংশে সফল হলেও তা পরিপূর্ণভাবে ত্রুটিমুক্ত নয়। এরূপ মতবাদটির বিরুদ্ধে যে-সমস্ত অভিযোগ উত্থাপিত করা যায়, সেগুলি হল-
[1] প্রতিরূপের যথার্থ উৎস বিষয়ে অজ্ঞতা:
লকের বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদ তথা প্রতিরূপী বস্তুবাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদনের মাধ্যমে বস্তু বা দ্রব্যকে কখনোই সরাসরিভাবে জানতে পারি না। আমরা সরাসরিভাবে যা জানি, তা হল বস্তুর ধারণা। কিন্তু সেই ধারণাটি যে ঠিক কোন্ বস্তুর প্রতিরূপ, তার কোনো নির্দেশিকা প্রতিরূপী বস্তুবাদে নেই।
[2] আংশিক বস্তুবাদী ও আংশিক ভাববাদী রূপ:
প্রতিরূপী বস্তুবাদের প্রবক্তা জন লক দাবি করেন যে, আমাদের বস্তুর প্রতিরূপ বা ধারণা গঠিত হয় গুণের মাধ্যমে। তিনি এই গুণগুলিকে দু-ভাগে বিভক্ত করেছেন- [i] মুখ্য গুণ ও [ii] গৌণ গুণ। মুখ্য গুণগুলি বস্তুগতরূপে গণ্য হওয়ায় লকের প্রবর্তিত মতবাদ বস্তুবাদে পরিণত হয়েছে। আবার গৌণ গুণগুলি ব্যক্তিসাপেক্ষরূপে গণ্য হওয়ায় তা ভাববাদে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, লকের বিজ্ঞানসম্মত প্রতীকবাদ বা প্রতিরূপী বস্তুবাদ একপ্রকার জ্ঞানতাত্ত্বিক দ্বৈতবাদের সৃষ্টি করেছে। আর জ্ঞানতাত্ত্বিক দ্বৈতবাদ কখনোই একটি নির্ভরযোগ্য মতবাদ নয়।
[3] মুখ্য ও গৌণ গুণগুলির পার্থক্যের অসংগতি:
প্রতীকবাদের প্রবক্তা জন লক মুখ্য ও গৌণ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তী দার্শনিক জর্জ বার্কলে মুখ্য ও গৌণ গুণের পার্থক্যকে অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, যে যুক্তিতে লক গৌণ গুণগুলিকে মনোগত বলেছেন, সেই একই যুক্তিতে মুখ্য গুণগুলিও মনোগতরূপে গণ্য। অর্থাৎ, মুখ্য ও গৌণ
গুণের পার্থক্যে অসংগতি দেখা যায়। সুতরাং, বস্তুর প্রতীক বা ধারণাগঠনের চিত্রটি আমাদের কাছে আদৌ স্পষ্ট নয়।
[4] জড়বস্তুকে পরোক্ষভাবে জানার অযৌক্তিক দাবি:
লকের প্রতীকবাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতীক বা ধারণার অন্তরালে যে দ্রব্যরূপী জড়বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় তা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। আর জড়বস্তু যদি অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়রূপে গণ্য হয়, তাহলে জড়বস্তুকে জানার কোনো উপায়ই গ্রাহ্য হতে পারে না। সুতরাং, ধারণা তথা প্রতীকের মাধ্যমে আমরা জড়বস্তুকে পরোক্ষভাবে জানি বলে যে দাবি করি, তা আদৌ যুক্তিসংগত নয়।
[5] বাহ্যজগতের ব্যাখ্যাপ্রদানে অক্ষমতা:
প্রতীকবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা যে জড়বস্তুকে জানি বলে দাবি করি, তা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়রূপে গণ্য। আর আমাদের এই বাহ্যজগৎ বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ জড়বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত বলে তারও কোনো যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং, প্রতীকবাদ বাহ্যজগতের যথাযথ ব্যাখ্যাপ্রদানে অক্ষম।
[6] বস্তুবাদকে বিপন্ন করা এবং ভাববাদের পথকে প্রশস্ত করা:
দার্শনিক লক বস্তুর অজ্ঞেয়তার বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, জড়দ্রব্য অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। লকের এরূপ অভিমত প্রতিরূপী বস্তুবাদকে ভাববাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বার্কলে তাই বলেছেন যে, জড়দ্রব্য জ্ঞাতা মনের ভাব ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুই নয়। সুতরাং, প্রতীকবাদ কখনোই একটি সন্তোষজনক মতবাদ নয়।
Read more