সরল বস্তুবাদের সবিচার আলোচনা
যে মতবাদে জ্ঞেয় বস্তু বা বিষয়ের মননিরপেক্ষ বা জ্ঞাননিরপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় এবং বস্তুর জ্ঞানকে সরাসরিভাবে ইন্দ্রিয় সংবেদনজাত প্রত্যক্ষরূপে উল্লেখ করা হয়, সেই মতবাদকেই বলা হয় সরল বস্তুবাদ। সরল বস্তুবাদ সাধারণ লোকের মতবাদরূপে গণ্য হওয়ায় একে লৌকিক বস্তুবাদরূপেও উল্লেখ করা হয়। এরূপ মতবাদে কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়মনীতি অনুসৃত না হওয়ায় একে অবৈজ্ঞানিক বস্তুবাদরূপেও গণ্য করা হয়। নির্বিচারেই এরূপ মতবাদটি গৃহীত বলে, একে নির্বিচার বস্তুবাদরূপেও অভিহিত করা হয়।
মূল প্রকৃতি বা স্বরূপ: সরল বা লৌকিক বস্তুবাদ অনুসারে, আমাদের বস্তুজ্ঞান হয় সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষের মাধ্যমে। আমাদের ইন্দ্রিয় অনুভবে বাহ্যবস্তু তার নিজস্ব স্বরূপ ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে প্রতিভাত হয়। এর অর্থ হল, বাহ্যবস্তু ঠিক যেমন, তেমনিভাবেই আমরা তাকে জানতে পারি। বাহ্যবস্তুর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বের বাইরে আমরা আর অন্য কোনো কিছু জানতে পারি না। এগুলিকে আমরা জানতে পারি সরাসরিভাবে, কখনোই পরোক্ষভাবে নয়। পরোক্ষভাবে বস্তুজ্ঞান হলে তাকে বলা হয় প্রতিরূপী বস্তুবাদ (representative realism)। এখানেই প্রতিরূপী বস্তুবাদের সঙ্গে সরল বস্তুবাদের মূল পার্থক্য লক্ষ করা যায়।
মূল বক্তব্য: সরল বস্তুবাদের মূল বক্তব্যগুলি হল-
i. জ্ঞেয় বস্তুর ইন্দ্রিয় সংবেদন: আমাদের জ্ঞেয় জগৎ হল নানাবিধ বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত এক বিচিত্র বাহ্যজগৎ। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদনের মাধ্যমে এই বিচিত্র বস্তুজগৎকে সরাসরিভাবে জানতে পারি।
ii. জ্ঞেয় বস্তুর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব: জ্ঞেয় বস্তুগুলি বাস্তবে
অস্তিত্বশীল বলে আমরা সেগুলিকে সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারি
এবং তাদের সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হই। এই সমস্ত বস্তুর
স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। এদের অস্তিত্ব কখনোই জ্ঞাতার মন বা
ধারণার ওপর নির্ভর করে না।
iii . জ্ঞেয় বস্তুর চেতনায় প্রভাব বিস্তার: বস্তুজ্ঞান সরাসরিভাবে
সম্পন্ন হওয়ার ফলে আমাদের চেতনা বা মন কখনোই বস্তুকে প্রভাবিত করতে পারে না। বরং জ্ঞেয় বস্তুই আমাদের মন বা চেতনাকে প্রভাবিত করে। এখানে চেতনার রঙে পান্না সবুজ হয় না, বরং সবুজ পান্নাই আমাদের সবুজের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে।
Iv. জ্ঞেয় বস্তুর মননিরপেক্ষ অস্তিত্ব: জ্ঞেয় বস্তুগুলি আমাদের মনের
বাইরে বাস্তব জগতে অবস্থান করে। তাই জ্ঞেয় বস্তুর গুণগুলিও আমাদের মনের বাইরে বাস্তবে অবস্থান করে। অর্থাৎ, বস্তু এবং বস্তুধর্ম উভয়েরই মননিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। বস্তুগুলিকে আমরা যেমন সরাসরিভাবে জানতে পারি, তেমনই বস্তুধর্ম তথা গুণগুলিকেও আমরা সরাসরিভাবে জানতে পারি।
V. জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর আকস্মিক সম্পর্ক: সরল বস্তুবাদ
অনুসারে জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্ক হল বাহ্যিক বা আকস্মিক। এদের সম্পর্ক কখনোই অভ্যন্তরীণ নয়। কারণ, এদের সম্পর্ক বিনষ্ট হলেও, এদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কোনো হানি হয় না।
সরল বস্তুবাদের সমালোচনা
সরল বস্তুবাদ হল সাধারণ মানুষের স্থূল বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি নির্বিচারমূলক মতবাদ। এরূপ মতবাদ কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরল বস্তুবাদের বিরুদ্ধে যেসকল অভিযোগগুলি উত্থাপিত করা যায়-
[1] ভ্রান্ত প্রত্যক্ষ অব্যাখ্যাত: সরল বস্তুবাদ কখনোই ভ্রান্ত প্রত্যক্ষের
ব্যাখ্যা দিতে পারে না। আমরা যদি সরাসরিভাবে সব কিছুই জানতে পারি, তাহলে ভ্রান্ত প্রত্যক্ষের বিষয়টি কীভাবে উত্থাপিত হতে পারে? অথচ ভ্রান্ত প্রত্যক্ষ, অমূল প্রত্যক্ষ প্রভৃতি বিষয়গুলি প্রায়শই আমাদের প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে।
[2] স্বপ্নজ্ঞান অব্যাখ্যাত: সরল বস্তুবাদ অনুযায়ী, মননিরপেক্ষভাবে
বিষয়ের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অস্তিত্ব আছে বলেই তা আমাদের জ্ঞানের বিষয়রূপে গণ্য। বিষয়ের অস্তিত্ব না থাকলে তার জ্ঞানও সম্ভব নয়। কিন্তু তা-ই যদি হয়, তাহলে স্বপ্নজ্ঞানের ব্যাখ্যা কীভাবে সম্ভব? এর কোনো যথার্থ উত্তর সরল বস্তুবাদীদের কাছে নেই। কারণ, স্বপ্নে আমরা অবাস্তব অনেক কিছুই দেখে থাকি। অথচ স্বপ্ন দৃষ্ট এই সমস্ত বিষয়কে আমরা কখনোই অস্বীকার করতে করতে পারি না।
[3] যথার্থ ও অযথার্থ জ্ঞানের পার্থক্য রচনায় অপারগতা: সরল
বস্তুবাদ অনুযায়ী সমস্ত জ্ঞানকেই যথার্থরূপে উল্লেখ করা হয়। এখানে অযথার্থ জ্ঞান বলে কিছুই থাকতে পারে না। কারণ, আমরা সমস্ত কিছুই সরাসরিভাবে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে লাভ করে থাকি। অথচ বাস্তবে যথার্থ ও অযথার্থ-দু-প্রকার জ্ঞানেরই পরিচয় পাওয়া যায়। সরল বস্তুবাদ যথার্থ জ্ঞান ও অযথার্থ জ্ঞানের পার্থক্য রচনা করতে সমর্থ নয় এবং সেকারণেই তা
গ্রহণযোগ্য নয়।
[4] প্রত্যক্ষের সর্বজনীন মাপকাঠির অভাব: সরল বস্তুবাদে জ্ঞানের
ক্ষেত্রে সরাসরিভাবে বস্তুপ্রত্যক্ষের বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বস্তুপ্রত্যক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপেক্ষিকরূপে গণ্য। কারণ, কোনো একটি বিষয় বা বস্তু একজনের কাছে বড়ো এবং অন্য একজনের কাছে ছোটো হিসেবে দেখা দিতে পারে। সুতরাং, সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষের কোনো সর্বজনীন মাপকাঠি নেই। সেকারণেই সরল বস্তুবাদকে গ্রহণ করা যায় না।
[5] জ্ঞানের বৈচিত্র্য অব্যাখ্যাত: সরল বস্তুবাদকে স্বীকার করে
নিলে জ্ঞানের বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করা একেবারেই সম্ভব নয়। বস্তু এবং বস্তুর গুণকে যদি আমরা সরাসরিভাবেই প্রত্যক্ষ করি, তাহলে বস্তু ও বস্তুর গুণ সবার কাছে সমান হয় না কেন? একই খাদ্য কারও কাছে সুস্বাদু, আবার কারও কাছে বিস্বাদ মনে হয় কেন?-এর কোনো সদুত্তর সরল বস্তুবাদীদের কাছে নেই। সুতরাং, সরল বস্তুবাদ কখনোই একটি গ্রহণযোগ্য মতবাদরূপে গণ্য হতে পারে না।