প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রশক্তি পরাজিত জার্মানির ওপর ভার্সাই সন্ধি (২৮ জুন, ১৯১৯ খ্রি.) চাপিয়ে দেয়।
ডার্সাই সন্ধির শর্তাবলি
ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি ছিল-
[1] ভৌগোলিক শর্ত: ভার্সাই সন্ধি অনুসারে জার্মানি-[i] ফ্রান্সকে আলসাস ও লোরেইন, [ii] বেলজিয়ামকে ইউপেন, ম্যালমেডি, মরেসনেট, [iii] ডেনমার্ককে শ্লেজভিগ, [iv] লিথুয়ানিয়াকে মেমেল বন্দর, [v] পোল্যান্ডকে পোজেন ও পশ্চিম প্রাশিয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া [vi] জার্মানির পূর্বদিকে স্বাধীন পোল্যান্ড রাষ্ট্র গঠন করা হয়। [vii] উত্তর সাইলেশিয়া ও পূর্ব প্রাশিয়া গণভোটের মাধ্যমে পোল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলে জার্মানি তাতে সম্মত হয়। [viii] সমুদ্রের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য পোল্যান্ডকে জার্মানির ভিতর দিয়ে 'পোলিশ করিডর' নামে রাস্তা দিতে বাধ্য করা হয়। [ix] জার্মানির ডানজিগ বন্দরকে 'উন্মুক্ত বন্দর' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। [x] জার্মানি তার বিভিন্ন উপনিবেশ ও অন্যান্য বিশেষ সুবিধাগুলি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। [xi] জার্মানি পশ্চিমদিকে ফ্রান্সকে যাতে আক্রমণ করতে না পরে সে জন্য পশ্চিমদিকে একটি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়।
[2] সামরিক শর্ত: ভার্সাই সন্ধির দ্বারা জার্মানির ভবিষ্যৎ শক্তিবৃদ্ধির সম্ভাবনা ধ্বংস করা হয়। [i] জার্মানির স্থল, জল ও বিমানবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। [ii] হেলিগোল্যান্ডের নৌঘাঁটি ভেঙে দেওয়া হয়। [iii] জার্মানির সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে ১ লক্ষ করা হয়। [iv] জার্মানিতে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষাদান নিষিদ্ধ হয়। [v] সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান নিষিদ্ধ হয়। [vi] রাইন নদীর পশ্চিম তীরে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে 'অসামরিক অঞ্চল' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। [vii] জার্মান সেনাপতিদের বরখাস্ত করা হয়। [viii] জার্মানিতে কামান, ট্যাংক, বোমারু বিমান প্রভৃতি তৈরি নিষিদ্ধ হয়। [ix] রাইন নদীর পূর্ব তীরে জার্মানির ব্যয়ে মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনী ও একটি কমিশন মোতায়েন করা হয়।
[3] অর্থনৈতিক শর্ত: জার্মানির অর্থনীতি পঙ্গু করার উদ্দেশ্যে ভার্সাই সন্ধির দ্বারা- [i] জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করে তার ওপর ৬৬০ কোটি পাউন্ডের বিপুল ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়। [ii] জার্মানির বেশিরভাগ বাণিজ্যপোত ফ্রান্সকে এবং যুদ্ধ জাহাজগুলি ইংল্যান্ডকে প্রদান করা হয়। [iii] জার্মনির কয়লাসমৃদ্ধ সার উপত্যকা ১৫ বছরের জন্য ফ্রান্সের অধিকারে চলে যায়। [iv] জার্মানি বিশেষ ধরনের কয়লা, লোহা, রবার ও বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ১০ বছরের জন্য ফ্রান্স, ইটালি, বেলজিয়াম ও লাক্সেমবার্গকে সরবরাহ করতে বাধ্য করা হয়। [v] জার্মানির বাজারে মিত্রপক্ষের পণ্য বিক্রিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। [vi] জার্মানির কয়েকটি জলপথ আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
[4] অন্যান্য শর্ত: [i] জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামকে 'যুদ্ধাপরাধী' হিসেবে অভিযুক্ত করে তাঁর বিচারের চেষ্টা করা হয়। [ii] আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। [iii] পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইউগোস্লাভিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়ার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।
মূল্যায়ন: ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা করা হয়, জার্মানির আপত্তিগুলি নাকচ করে এবং জার্মানিকে বিমান আক্রমণের হুমকি দিয়ে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়। এজন্য জার্মান ঐতিহাসিকরা এই সন্ধিকে 'জবরদস্তিমূলক সন্ধি' বলে অভিহিত করে। ঐতিহাসিক'ই এইচ কার বলেছেন যে, "এই জবরদস্তিমূলক সন্ধি পালনের বিষয়ে জার্মানির কোনো নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল না।"
Read More