বিবেকানন্দের কর্মযোগের ধারণায় প্রয়োগমূলক বেদান্তের প্রতিফলন
স্বামী বিবেকানন্দ হলেন অদ্বৈত বেদান্তের একজন আধুনিক ভাষ্যকার। প্রয়োগমূলক অদ্বৈত বেদান্তের (practical vedanta) চিন্তাধারা তাঁর দার্শনিক উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করেছে। বেদান্ত দর্শনের মূলভিত্তি হল-
উপনিষদ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং ব্রহ্মসূত্র নামক প্রস্থানত্রয়। উপনিষদকে বেদান্তের শ্রুতি প্রস্থান, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে বেদান্তের স্মৃতি প্রস্থান এবং ব্রহ্মসূত্রকে বেদান্ডের ন্যায় প্রস্থানরূপে উল্লেখ করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দ যেহেতু অদ্বৈত বেদান্তের চিন্তাধারার বাহক, সেহেতু তাঁর দার্শনিক উপলব্ধির ক্ষেত্রে এই তিনটি প্রস্থানেরই ছাপ পাওয়া যায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এবং কর্মযোগ প্রভৃতি বিষয় বিবেকানন্দের দার্শনিক উপলব্ধির ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর দার্শনিক উপলব্ধির ক্ষেত্রে কর্মযোগের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
কর্মযোগের অর্থে বেদান্তের প্রতিফলন:
গীতায় কর্মযোগের অর্থটিকে কর্মের কৌশলরূপেই উল্লেখ করা হয়েছে। কর্ম বলতে কর্ম করাকে এবং যোগ বলতে কীভাবে কর্ম করা উচিত—সেই বিষয়ে নির্দেশ করা হয়েছে। আরও সহজ করে বলা যায় যে, কর্মের কৌশল তথা কর্মনৈপুণ্যকেই বলা হয়েছে কর্মযোগ। অর্থাৎ, কর্মের মাধ্যমে লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় সমস্ত কিছুকেই সমান জ্ঞান করে কর্মের অনুষ্ঠান বা সম্পাদন করাকেই বলা হয় কর্মযোগ। এরূপ কর্মযোগের ওপরই বিবেকানন্দের দার্শনিক চিন্তন প্রতিফলিত হয়েছে। আর তাঁর এই দার্শনিক চিন্তনকে সমৃদ্ধ করেছে অদ্বৈত বেদান্তের চিন্তাধারা। বেদান্তের অনুগামী হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ কর্মযোগ-এর এরূপ অর্থটিকেই গ্রহণ করেছেন।
কর্মযোগে আত্মজ্ঞানের প্রতিফলন: বিবেকানন্দ উল্লেখ করেছেন যে, মানুষের জীবন মাত্রেই কর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মনুষ্যকৃত কর্মে ভালোমন্দ, পাপপুণ্য-এই সমস্ত দিকই আছে। সুতরাং, কর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মানুষের জীবন কখনোই কর্মকে এড়িয়ে চলতে পারে না। কর্মের জন্যই কর্মফলের বিষয়টি উঠে আসে। সেকারণেই মানুষের কর্মে সহযোগীর ভূমিকা গ্রহণ করে জন্মান্তরবাদ। কর্মফল একজন্মে সম্ভব না হলেও, তা পরজন্মে সম্ভব হয়। এর ফলে মানুষ আত্মজ্ঞানে উদ্দীপ্ত হয়। আত্মজ্ঞানে মানুষ উপলব্ধি করে যে, আত্মা চিরন্তন, অমর ও জন্মমৃত্যুরহিত। জন্ম হল আত্মার শরীরধারণ আর মৃত্যু হল আত্মার শরীরমুক্তি। আমাদের সমস্তপ্রকার কর্মের উৎসই হল শরীর, আর কর্মই হল শরীরের মন্ত্র।
কর্মযোগই হল আধ্যাত্মিক শিক্ষার উৎস:
বিবেকানন্দ তাঁর 'কর্মযোগ'-এ বলেছেন যে, মানুষের জীবনের কর্মই হল আধ্যাত্মিক শিক্ষার পাঠশালা। যদি কেবল সাংসারিক লাভের জন্য কর্ম করা হয়, তাহলে তা আত্মার বন্ধনকেই বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু যদি আত্মজ্ঞানের জন্য কর্ম করা হয়, তাহলে তা অদ্বৈত বেদান্তের মূলভাবকেই জাগরিত করে। অদ্বৈত বেদান্তের মূলভাবই হল-অহং ব্রহ্মাস্মি অর্থাৎ আমিই হলাম ব্রহ্ম। এখানেই বিবেকানন্দের কর্মযোগের ক্ষেত্রে বেদান্তের মূল ভাব ও উদ্দেশ্যটি নিহিত।
কর্মযোগের নিষ্কাম কর্মে বেদান্তের আদর্শগত প্রতিফলন:
বিবেকানন্দের মতে, স্বার্থযুক্ত কর্ম হল ক্রীতদাস সুলভ কর্ম। কিন্তু নিঃস্বার্থ কর্ম বা নিষ্কাম কর্মই হল প্রকৃত ও আদর্শগত কর্ম। নিষ্কামভাবে কর্ম করার বিষয়টি উপনিষদ ও বেদান্তে যেমন নির্দেশিত হয়েছে, তেমনই তা আবার বিবেকানন্দের কর্মযোগেও প্রতিফলিত হয়েছে। নিষ্কামভাবে কর্ম করার কথাই বলা হয়েছে কর্মযোগ-এ, যা মানুষকে অনাসক্ত করে ব্রহ্মের অভিমুখী করে তোলে।