১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সেডানের যুদ্ধ ও ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপ পরস্পর-বিরোধী দুটি সশস্ত্র শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়-[1] একদিকে থাকে ইটালি, অস্ট্রিয়াকে নিয়ে গড়ে ওঠা 'ত্রিশক্তি চুক্তি' বা ট্রিপল্ল এলায়েন্স, [2] অন্যদিকে থাকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি দেশকে নিয়ে গঠিত 'ত্রিশক্তি মৈত্রী' বা 'ট্রিপ্ল আঁতাঁত' নামে জোট।
ত্রিশক্তি মৈত্রী' বা 'ট্রিপল আঁতাঁত' গঠন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপে ত্রিশক্তি মৈত্রী বা ট্রিপ্ল আঁতাঁত গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট/কারণ ছিল-
[1] কাইজারের বিশ্বরাজনীতি: বিসমার্কের পদচ্যুতির (১৮৯০ খ্রি.) পর জার্মান সম্রাট বা কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম বিসমার্কের শান্তিবাদী নীতি ত্যাগ করে বিশ্বরাজনীতিতে সক্রিয় হস্তক্ষেপের নীতি গ্রহণ করেন। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে জার্মানিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে স্থাপন করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। লর্ড অক্সফোর্ডের মতে, "কাইজার দাবি করেন যে, জার্মানিকে বাদ দিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান করা চলবে না।"
[2] রিইনস্যুরেন্স চুক্তি নাকচ : জার্মান প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক রাশিয়ার সঙ্গে অনাক্রমণমূলক রিইনস্যুরেন্স চুক্তি (১৮৮৭ খ্রি.) স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু বিসমার্কের পতনের পর জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম রাশিয়ার সঙ্গে রিইনস্যুরেন্স চুক্তি বাতিল (১৮৯০ খ্রি.) করেন। ফলে জার্মানির সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
[3] জার্মানির রুশ-বিরোধী নীতি: [i] জার্মানির কাছে
রাশিয়া ঋণ চাইলে কাইজার কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যান, [ii] বালগেরিয়ার সিংহাসনে জার্মান রাজবংশকে বসানোর প্রচেষ্টা, [iii] রাশিয়া সম্পর্কে কাইজারের স্ত্রীর অপমানজনক মন্তব্য প্রভৃতির ফলে জার্মানির ওপর রাশিয়ার ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়।
[4] ফ্রাঙ্কো-রুশ চুক্তি: জার্মানি ও রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটার পর বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। যেমন- [i] রাশিয়ার অর্থসংকট দূর করার উদ্দেশ্যে ফ্রান্স মাত্র ৩% সুদে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাশিয়াকে ঋণ দেয়। [ii] ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে একটি গোপন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত (১৮৯৩ খ্রি.) হয়। [iii] ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে ফ্রাঙ্কো-রুশ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
[5 ] জার্মানির ব্রিটিশবিরোধী নীতি: কাইজার-[i] বিরাট নৌবহর নির্মাণের উদ্যোগ নিলে, [ii] উপনিবেশ স্থাপনে সক্রিয় হয়ে উঠলে, [iii] ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় বিদ্রোহী বোয়ার-এর প্রেসিডেন্ট ক্রুগারকে সমর্থন করলে, ইংল্যান্ড জার্মানির ওপর প্রবল ক্ষুব্ধ হয়।
[6] ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি: এই অবস্থায় ফ্রান্স ও রাশিয়ার সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ইংল্যান্ড তাদের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। এদিকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে ফ্রান্সও আগ্রহ দেখায়। এই অবস্থায় তাদের মধ্যে ইঙ্গ-ফরাসি মৈত্রী চুক্তি (১৯০৫ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি 'আঁতাঁত কোর্দিয়াল' বা 'ঘনিষ্ঠ মিত্রতা' নামে পরিচিত।
[7] ইঙ্গ-বুশ চুক্তি: রাশিয়া জাপানের কাছে পরাজিত (১৯০৪ খ্রি.) হয়ে দূর প্রাচ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি থেকে সরে এসে বলকান অঞ্চলের দিকে নজর দেয়। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে দূর প্রাচ্যে ইংল্যান্ডের বিরোধিতা কমে এবং বলকানে জার্মানির বিরোধিতা বাড়ে। এই অবস্থায় ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং ইঙ্গ-রুশ মৈত্রী চুক্তি (১৯০৭ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়।
[৪] ত্রিশক্তি আঁতাঁত: ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্কো-রুশ চুক্তি, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি ও ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-রুশ চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স, রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ত্রিশক্তি আঁতাঁত গঠিত হয়।
মূল্যায়ন: ত্রিশক্তি আঁতাঁতের মধ্যে কোনো সামরিক শর্ত না থাকলেও এর ভিত্তি খুবই শক্তিশালী ছিল। যথাসময়ে এতে সামরিক শর্তাদি যুক্ত হয়। এর ফলে বিংশ শতকের শুরুতে ইউরোপ কার্যত দুটি সশস্ত্র শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরস্পর- বিরোধী এই জোট গঠনের পরিণামে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।