বস্তুবাদের মূল বক্তব্য যে জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ অনুযায়ী জ্ঞেয় বস্তু বা বিষয়ের জ্ঞাননিরপেক্ষ বা মননিরপেক্ষ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়, সেই মতবাদকেই বলা হয় বস্তুবাদ (realism)। জ্ঞানের প্রকৃতি তথা স্বরূপের পরিপ্রেক্ষিতে 'বস্তুবাদ' হল একটি বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদ। বস্তুবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল-
[1] জ্ঞানের মৌল ভিত্তি হিসেবে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বন্ধু: বস্তুবাদে জ্ঞেয় বস্তুর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বস্তুবাদের মূল বিষয়ই হল বস্তু। প্রত্যেকটি বস্তুই হল জ্ঞেয় বস্তু, অর্থাৎ জ্ঞানের বিষয়। এই জ্ঞেয় বস্তুর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে আমাদের জ্ঞান লাভ করা আদৌ সম্ভব নয়। স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বস্তুই হল জ্ঞানের মৌল ভিত্তি।
[2] জ্ঞাতার জ্ঞাননিরপেক্ষ হিসেবে বন্ধু: বস্তু আছে বলেই আমাদের বস্তু সম্বন্ধীয় জ্ঞান লাভ হয়। সুতরাং বস্তুর জ্ঞান না হলে যে বস্তুর কোনো অস্তিত্ব নেই, এমন কথা বস্তুবাদে স্বীকার করা হয় না। অর্থাৎ, বস্তু বা বিষয়কে আমরা জানি বা না জানি, তাতে বস্তুর অস্তিত্বের কোনো হানি ঘটে না। তাই বস্তুর অস্তিত্ব আমাদের জানার ওপর আদৌ নির্ভরশীল নয়।
[3] বন্ধু ও বন্ধুজ্ঞানের বাহ্যিক সম্পর্ক: বস্তুবাদে বস্তু এবং বস্তুর
জ্ঞানের মধ্যে একপ্রকার সম্পর্ককে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এই সম্পর্ক আদৌ অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক নয়, শুধুই বাহ্যিক সম্পর্ক। কারণ বস্তু এবং বস্তুজ্ঞানের মধ্যে যদি সম্পর্ক ছিন্ন হয় তাহলে বস্তুর অস্তিত্বের কোনো হানি হয় না।
[4] বস্তুর চিরকালীন অস্তিত্ব: বস্তুবাদী দার্শনিকরা বস্তুর বহুত্বকে
স্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে, পার্থিব জগতে অজস্র বস্তু আছে। এই বস্তুগুলির অস্তিত্ব অবশ্যই আমাদের মনের বাইরে। আমরা এগুলিকে জানি বা না জানি, এদের অস্তিত্ব অতীতেও ছিল, বর্তমানেও রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। জগতে এমন অনেক বিষয় বা বস্তু আছে যেগুলি সম্পর্কে আমরা এখনও কিছু জানি না, কিন্তু ভবিষ্যতে জানলেও জানতে পারি।
[5] জ্ঞানের হেতুরূপে বন্ধু: বস্তুবাদীদের মতে, আমাদের বস্তুজ্ঞান
বস্তুকে সর্বদাই অনুসরণ করে, বস্তু কখনোই আমাদের জ্ঞানকে অনুসরণ করে না। এর কারণ, বস্তুবাদীরা আগে বস্তুর অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন। তারপর বস্তুজ্ঞানের বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন। তাই বস্তুর অস্তিত্ব আমাদের জ্ঞানের হেতুরূপে গণ্য। আমাদের জ্ঞান কখনোই বস্তুর অস্তিত্বের হেতু নয়।
[6] বস্তুর গুণের মননিরপেক্ষ অস্তিত্ব:
বস্তুবাদে বস্তুর মননিরপেক্ষ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বাহ্য অস্তিত্বকে যেমন স্বীকার করা হয়েছে, তেমনই বস্তুগুণের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বাহ্য অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বস্তু ও বস্তুর গুণের এরূপ অস্তিত্বই বস্তুকে যথাযথভাবে আমাদের কাছে উপস্থাপিত করে।