বস্তুগত ভাববাদ ও আত্মগত ভাববাদের মূল পার্থক্য
ভাববাদের মূল বক্তব্য এক হলেও তাদের মধ্যে দুটি রূপ দেখা যায়। এই দুটি রূপের একটি হল আত্মগত ভাববাদ (subjective idealism) এবং অপরটি হল বস্তুগত ভাববাদ (objective idealism)। ভাববাদের এই দুটি রূপ নিয়ে আলোচনা করা হল-
আত্মগত ভাববাদ (Subjective Idealism): আত্মগত ভাববাদ অনুসারে দাবি করা হয়েছে যে, বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই। বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে জ্ঞাতার মনের ওপর। কারণ, জ্ঞেয় বস্তু মাত্রেই তা মনের ধারণা মাত্র। আর এই ধারণা ব্যক্তিমনের ধারণাও হতে পারে, আবার তা ঈশ্বরমনের ধারণাও হতে পারে। ব্যক্তিমন বা ঈশ্বরমন যাই হোক না কেন, মনের ধারণারূপেই বাহ্যবস্তুগুলি অস্তিত্বশীল। আত্মগত ভাববাদের মুখ্য প্রবক্তা হলেন প্রখ্যাত অভিজ্ঞতাবাদী ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ বার্কলে। তিনি তাঁর বিখ্যাত অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর (Esse est Percipi) তত্ত্বটির মাধ্যমে আত্মগত ভাববাদের বিষয়টিকে প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর এরূপ তত্ত্বে উল্লেখ করেছেন যে, বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে জ্ঞাতার প্রত্যক্ষের ওপর। অর্থাৎ, জ্ঞাতার প্রত্যক্ষিত বিষয় যা নয়, তার কোনো অস্তিত্বও নেই।
বস্তুগত ভাববাদ (Objective Idealism): বস্তুগত ভাববাদ অনুসারেও দাবি করা হয় যে, সমস্ত বস্তুর অস্তিত্বই হল চেতনানির্ভর। চেতনা ছাড়া বস্তুর অস্তিত্ব কখনোই নিরূপিত হতে পারে না। তবে এই চেতনা বা চৈতন্য কখনোই ব্যক্তি-চৈতন্য নয়, এ হল পরমব্রত্মের চৈতন্য। আমরা যাকে ব্যক্তি- চেতনারূপে উল্লেখ করি, তাও কিন্তু পরমচৈতন্যের প্রকাশ মাত্র। ব্যক্তি- চৈতন্যও তাই পরমব্রত্ন-চৈতন্যের ওপর নির্ভরশীল। বস্তুগত ভাববাদ অনুসারে তাই বলা যায় যে, এই বাহ্য জড়জগৎ এবং আমাদের মনোজগৎ- সমস্ত কিছুই হল পরমব্রহ্ম-চৈতন্যের প্রকাশ মাত্র। আর তাই জড়জগৎ এবং মনোজগতের সমস্ত কিছুই অস্তিত্বশীল। অর্থাৎ, সব কিছুই হল সৎ। বস্তুগত ভাববাদের মুখ্য প্রবক্তা হলেন প্রখ্যাত ভাববাদী দার্শনিক হেগেল। তাঁর মতে, জগতের সমস্ত কিছুই যেহেতু পরমব্রত্মের চৈতন্য বা বিস্ময়ের প্রকাশ, সেহেতু জড় ও মন সবই সৎ। তাই তিনি বলেন—যা পরমব্রত্মের প্রকাশ তাই হল সৎ এবং যা সৎ তা-ই হল পরমব্রত্ম।
বার্কলের মতবাদকে অহংসর্বস্ববাদ বলার কারণ
বার্কলের আত্মগত ভাববাদের অনিবার্য পরিণতি হল অহংসর্বস্ববাদ (solipsism)। অহংসর্বস্ববাদের মূল বক্তব্য হল কেবল আমি এবং আমার ধারণাই সত্য, এ ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুরই সত্যতা বা অস্তিত্ব নেই। বার্কলের মূল বক্তব্য হল-অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর (Esse est Percipi) অর্থাৎ, আমি যা কিছুই প্রত্যক্ষ করি, শুধু তারই অস্তিত্ব আছে। আমার প্রত্যক্ষের বাইরে আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্বের জন্য সমস্ত কিছুই আমার প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভরশীল বলে বার্কলের মতবাদ অহংসর্বস্ববাদে পরিণত। আমি যখন কোনো টেবিলকে প্রত্যক্ষ করি, তখন তা আমার প্রত্যক্ষের অন্তর্ভুক্ত বলেই অস্তিত্বশীলরূপে গণ্য। কিন্তু যখন আমি তাকে প্রত্যক্ষ করি না, তখন তার অস্তিত্বও আমার কাছে গ্রাহ্য নয়। সুতরাং আমার প্রত্যক্ষের ওপরই টেবিলের অস্তিত্ব নির্ভরশীল বলে বার্কলের মতবাদ অহংসর্বস্ববাদে পরিণত হয়েছে।