ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। মহাদেশীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে শিল্পায়ন শুরু হয় আরও ৫০ থেকে ১০০ বছর পর।
ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম/মহাদেশীয় ভূখন্ডে দেরিতে শিল্পায়ন ঘটার কারণ
সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার বা মহাদেশীয় ভূখণ্ডে শিল্পায়ন দেরিতে শুরু হওয়ার কারণগুলি ছিল-
[1] অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ: ইংল্যান্ডেㅡ[i] কয়লা ও লোহার প্রাচুর্য, [ii] বস্ত্রশিল্পের অনুকূল স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া, [iii] তীব্র বায়ু ও জলশক্তি শিল্পের বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। এতকিছু প্রাকৃতিক সুবিধা একত্রে মহাদেশীয় ভূখণ্ডের দেশগুলিতে ছিল না।
[2] কাঁচামাল সংগ্রহ: ইংল্যান্ড তার সুবিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য থেকে নিয়মিত শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের সুযোগ পেয়েছিল। এমন সুবিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির না থাকায় তারা শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়।
[3] বাজার: ইংল্যান্ড নিজের দেশে বিক্রির পর তার উদ্বৃত্ত শিল্পপণ্য তার বিভিন্ন উপনিবেশের বাজারগুলিতে বিক্রির সুযোগ পেয়েছিল। উপনিবেশের অভাবে অন্যান্য দেশগুলি সে সুযোগ পায়নি।
[4] সুলভ শ্রমিক: অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংল্যান্ডের কারখানাগুলিতে প্রচুর সংখ্যায় সুলভ শ্রমিকের জোগান ছিল। কিন্তু মহাদেশের অন্যান্য দেশগুলিতে সুলভ শ্রমিকের যথেষ্ট অভাব ছিল।
[ 5] কৃষির অগ্রগতি: অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে কৃষি উৎপাদনও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ফলে-[i] শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, [ii] শ্রমিকদের জন্য সস্তায় খাদ্যের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়, [iii] কৃষকদের শিল্পদ্রব্য কেনার চাহিদা বাড়ে। কৃষিক্ষেত্রে এতটা অগ্রগতি মহাদেশীয় ভূখণ্ডের দেশগুলিতে ঘটেনি।
[6] রাজনৈতিক স্থিরতা: অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক স্থিরতা আসে যা ইংল্যান্ডে শিল্প বিকাশে সহায়তা করে। কিন্তু মহাদেশের অন্যান্য কয়েকটি দেশে, যেমন-ফ্রান্সের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে বিপ্লব-জনিত অস্থিরতার ফলে শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হয়।
[7] সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা: দেশে শিল্পের প্রসারে ব্রিটিশ সরকার বণিক ও শিল্পপতিদের নানাভাবে সহায়তা করে। কিন্তু অন্যান্য দেশের বণিক ও শিল্পপতিদের সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে শিল্পের প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
[৪] বাণিজ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি: ইংল্যান্ড সপ্তদশ শতকের মধ্যেই কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র থেকে বাণিজ্যনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনীতি খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠায় তারা শিল্প প্রতিষ্ঠায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পায়। কিন্তু অন্যান্য দেশগুলির বাণিজ্যে এরূপ সমৃদ্ধি আসেনি।
[9] যোগাযোগ ও পরিবহন: [i] সমুদ্রবেষ্টিত ইংল্যান্ডের নৌশক্তি ছিল বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ। পণ্যবোঝাই ব্রিটিশ জাহাজগুলি সমুদ্রপথে পৃথিবীর সব দেশে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত। [ii] দেশের উপকূলে অবস্থিত অসংখ্য বন্দর থেকে খাল ও নদীপথে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহনের সুবিধা ছিল যথেষ্ট উন্নত। অন্যান্য দেশগুলির যোগাযোগ ব্যবস্থা ইংল্যান্ডের তুলনায় খুবই পিছিয়ে ছিল।
[10] বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার: অষ্টাদশ শতকে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ইংল্যান্ডের শিল্পায়নে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। যেমন-[i] উড়ন্ত মাকু, স্পিনিং জেনি, ওয়াটার ফ্রেম, মিউল, পাওয়ার লুম প্রভৃতি যন্ত্রগুলি বস্ত্রশিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটায়, [ii] বাষ্পীয় ইঞ্জিন, ব্লাস্ট ফার্নেস, নিরাপত্তা বাতি প্রভৃতির আবিষ্কার কলকারখানাগুলি চালানোর পক্ষে সহায়ক হয়। অন্যান্য দেশ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি ইংল্যান্ডের মতো ব্যবহারের সুযোগ পায়নি।
মূল্যায়ন: ইংল্যান্ডে শিল্পায়নের সব উপাদানই ছিল বলে সেদেশে শিল্পায়নের বিকাশ সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল। অন্যান্য দেশে দেখা যায় যে, একটি উপাদানের অস্তিত্ব থাকলেও অন্য একটি উপাদানের অস্তিত্ব না থাকায় তারা ইংল্যান্ডের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিল।