প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি ইটালি ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রি.) আগে বিভিন্ন ছোটোবড়ো পরস্পর-বিরোধী রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন এই রাজ্যগুলি জয় করে ঐক্যবদ্ধ করলেও তাঁর পতনের পর ভিয়েনা বন্দোবস্তের দ্বারা ইটালিকে আবার বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত করে সেখানে অস্ট্রিয়া- সহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।
জোসেফ ম্যাৎসিনি ও ইয়ং ইটালি আন্দোলন
ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইটালির জাতীয়তাবাদীরা রাজনৈতিক ঐক্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন জোসেফ ম্যাৎসিনি (১৮০৫-'৭২ খ্রি.)। ঐতিহাসিক গ্রেনভিলের মতে, ম্যাৎসিনি ছিলেন "ইটালির প্রজাতান্ত্রিক ঐক্যের মস্তিষ্ক এবং বিধিপ্রেরিত নায়ক।"
[1] প্রথম জীবন: ম্যাৎসিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, সুলেখক, চিন্তাবিদ, বাগ্মী, ও বিপ্লবী। তিনি ইটালির জেনোয়া প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন (১৮০৫ খ্রি.)। অল্প বয়সেই তিনি স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ইটালির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। প্রথম জীবনে তিনি কার্বোনারি নামে এক গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিয়ে ইটালিকে বিদেশি শাসনমুক্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শীঘ্রই এই আন্দোলনের দুর্বলতা উপলব্ধি করে তিনি এই দল ত্যাগ করেন। বিদ্রোহে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে কারাদণ্ড ও নির্বাসন দেওয়া হয়।
[2] আদর্শ: ম্যাৎসিনি উপলব্ধি করেন যে, ইটালির ঐক্যের পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা হল অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি ইটালির যুবশক্তিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুরোধ করেন। তাঁর আদর্শ ছিল বিদেশি শক্তির সহায়তা ছাড়া ইটালিবাসী রক্ত ঝরিয়ে দেশে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। তিনি বলেন, "শহীদের রক্ত যত ঝরবে, আদর্শের বীজ ততই ফলবতী হবে।"
[3] ইয়ং ইটালি দল গঠন: দেশবাসীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ম্যাৎসিনি নির্বাসিত অবস্থায় ফ্রান্সের মার্সাই শহরে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে 'ইয়ং ইটালি' বা 'নব্য ইটালি' নামে যুবদল প্রতিষ্ঠা করেন। এই দল শিক্ষা, আত্মত্যাগ ও চরিত্র নিষ্ঠার দ্বারা দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধের প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নেয়। এই দল শীঘ্রই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই দলের সদস্যসংখ্যা ৩০ হাজারে পৌঁছায়। ম্যাৎসিনি 'ইয়ং ইটালি' নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন।
[4 ] ফেব্রুয়ারি বিপ্লব: ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে ইটালিতেও ব্যাপক জাগরণ দেখা দেয়। ভেনিসে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নেপল্স, মিলান, লম্বার্ডি প্রভৃতি রাজ্যেও তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজা চার্লস অ্যালবার্ট অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এসময় ম্যাৎসিনি নির্বাসন ছেড়ে ইটালিতে ফিরে এসে ইয়ং ইটালির সদস্যদের নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর নেতৃত্বে রোম ও টাস্কানিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
[5] ব্যর্থতা: সংগঠনের অভাব, অস্ট্রিয়া ও ফরাসি শক্তির তীব্র দমননীতির ফলে ইয়ং ইটালির আন্দোলন স্তব্ধ হয়। শেষপর্যন্ত তাঁর আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। রোম ও টাস্কানির প্রজাতন্ত্র ধ্বংস হয়। ম্যাৎসিনি ভগ্নহৃদয়ে বাকি জীবন লন্ডনে কাটান।
মূল্যায়ন: ম্যাৎসিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি ইটালিবাসীর মনে দেশপ্রেমের যে আগুন জ্বালিয়েছিলেন তা পরবর্তীকালে ইটালির ঐক্য আন্দোলনকে শক্তিশালী করে। ম্যাৎসিনির বিফলতা ছিল এক মহান বিফলতা মাত্র। ঐতিহাসিক লিপসন বলেছেন যে, "নতুন ইটালির স্রষ্টাদের মধ্যে ম্যাৎসিনি এক অবিস্মরণীয় স্থান অধিকার করে আছেন।"