জার্মানির প্রথম পর্বের ঐক্য আন্দোলন (১৮১৫-১৮৪৮ খ্রি.) ব্যর্থ হওয়ার পর জার্মানির ঐক্য নিয়ে হতাশা ও জটিলতা দেখা দেয়। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে বসেন সুদক্ষ কূটনীতিবিদ অটো ফন বিসমার্ক।
জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বিসমার্কের অবদান
বিসমার্ক ছিলেন ঐক্যবদ্ধ জার্মানির প্রাণপুরুষ। জার্মানির ঐক্য স্থাপনে তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। বিসমার্ক প্রাশিয়ার প্রতিনিধি সভার মতামত অগ্রাহ্য করে এক শক্তিশালী সেনাদল গড়ে তোলেন এবং মূলত তিনটি সফল যুদ্ধের দ্বারা ১৮৬৪ থেকে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। যেগুলি হল-
[1] ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ: [i] যুদ্ধ: ডেনমার্কের রাজা লন্ডন চুক্তি (১৮৫২ খ্রি.) লঙ্ঘন করে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে শ্লেজউইগ ও হলস্টাইন নামে প্রদেশ দুটি সরাসরি দখল করে নেন। ফলে বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (১৮৬৪ খ্রি.) করেন।
[ii] গ্যাস্টিনের চুক্তি: যুদ্ধে পরাজিত ডেনমার্ক গ্যাস্টিনের চুক্তি (১৮৬৫ খ্রি) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। চুক্তিতে স্থির হয় যে-(a) প্রাশিয়া শ্লেজউইগ এবং অস্ট্রিয়া হলস্টাইন লাভ করবে। (b) ভবিষ্যতে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া যৌথভাবে শ্লেজউইগ-হলস্টাইন সমস্যার সমাধান করবে। (c) অস্ট্রিয়া ডাচি দুটির সমস্যা জার্মান বুন্ডে উত্থাপন করবে না। অধ্যাপক এ জে পি টেলর-এর মতে, বিসমার্ক গ্যাস্টিনের চুক্তির শর্তাবলি এমনভাবে স্থির করেন যাতে কিছুদিনের মধ্যেই অস্ট্রিয়ার সঙ্গে প্রাশিয়ার বিরোধ বাধে।
[2] অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ: [i] স্যাডোয়ার যুদ্ধ: ইতিমধ্যে অস্ট্রিয়ার জনপ্রিয়তা কমে গেলে অস্ট্রিয়া জার্মান বুন্ডের সভায় শ্লেজউইগ-হলস্টাইন প্রদেশ দুটি
ডিউক অব অগাস্টেনবার্গকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ফলে গ্যাস্টিনের চুক্তি ভঙ্গের অজুহাতে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (১৮৬৬ খ্রি.) করেন। অস্ট্রিয়া স্যাডোয়ার যুদ্ধে (১৮৬৬ খ্রি.) প্রাশিয়ার কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়।
[ ii] প্রাগের সন্ধি: প্রাশিয়ার কাছে পরাজিত অস্ট্রিয়া প্রাগের সন্ধি (১৮৬৬ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধির দ্বারা-(a) অস্ট্রিয়া জার্মানির নেতৃত্ব ত্যাগ করে, (b) মেইন নদীর উত্তরের জার্মান রাজ্যগুলি প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং (c) যুদ্ধের সময় যে বড়ো জার্মান রাজ্যগুলি অস্ট্রিয়ার পক্ষ নিয়েছিল সেই রাজ্যগুলি বিসমার্ক দখল করেন।
[ 3] ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ:
[i] সেডানের যুদ্ধ: বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তাদের মধ্যে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শুরু হয়। সেডানের যুদ্ধে (১৮৭০ খ্রি.) ফ্রান্স চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। [ii] ফ্রাঙ্কফোর্টের সন্ধি: পরাজিত ফ্রান্স প্রাশিয়ার সঙ্গে ফ্রাঙ্কফোর্টের সন্ধি (১৮৭১ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধির দ্বারা-(a) ফ্রান্স আলসাস ও লোরেইন প্রদেশ দুটি জার্মানিকে ছেড়ে দেয়। (b) ফ্রান্স ৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। (c) দক্ষিণ ও উত্তর জার্মানি সংযুক্ত হলে ফ্রান্স তা মেনে নেয়।
মূল্যায়ন: এই তিনটি যুদ্ধের দ্বারা বিসমার্ক জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। প্রাশিয়ার রাজা প্রথম উইলিয়াম ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সম্রাট হন। ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে বিসমার্ক একটি সংবিধান চালু করেন। নবগঠিত জার্মান রাষ্ট্রটি পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যেই ইউরোপ তথা বিশ্বের অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়।