ক্রিমিয়ার যুদ্ধের (১৮৫৪-১৮৫৬ খ্রি.) নেপথ্যে দুটি বিপরীতমুখী স্বার্থ বিশেষভাবে কাজ করেছিল-একদিকে ছিল রাশিয়ার দ্বারা তুরস্ককে গ্রাস করার চেষ্টা, অন্যদিকে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশ কর্তৃক তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন-
[1] লন্ডনের সন্ধি: রাশিয়া তুরস্কের ওপর উনকিয়ার স্কেলেস্কি-র সন্ধি (১৮৩০ খ্রি.) চাপিয়ে দিয়ে বসফোরাস ও দার্দনেল্ল্স প্রণালীতে রুশ জাহাজ চলাচলের অধিকার পায়। রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। শেষপর্যন্ত লন্ডনের সন্ধির (১৮৪০ খ্রি.) দ্বারা যুদ্ধের সময় বসফোরাস ও দাদনেল্ল্স প্রণালীতে সব দেশের যুদ্ধজাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ হয়।
[2] রুশ আগ্রাসন: কৃয়সাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে রুশ জার প্রথম নিকোলাস (১৮২৫-১৮৫৫ খ্রি.) ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের কাছে তুরস্ককে রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ব্যবচ্ছেদের প্রস্তাব দেন।
[3] ইংল্যান্ডের ভূমিকা: রাশিয়ার প্রস্তাবের উত্তরে ইংল্যান্ড সুস্পষ্টভাবে তার ইচ্ছা না জানিয়ে নীরব থাকে এবং বলে যে, "এখনই এই রুগ্ন ব্যক্তির মৃত্যু হবে না।” ফলে জার নিকোলাসের ধারণা হয় যে, তুরস্কের ব্যবচ্ছেদে ইংল্যান্ড খুব বেশি অরাজি হবে না। কিন্তু রাশিয়া যখন তুরস্কে আগ্রাসন চালায় তখন ইংল্যান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠে।
[4] ফ্রান্সের যুদ্ধাকাঙ্ক্ষা: ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধাতে চাইছিলেন, কারণ- [i] তিনি অত্যন্ত সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে ফ্রান্সের গরিমা বৃদ্ধি করতে চাইছিলেন।
[ii] তিনি রাশিয়াকে পরাজিত করে ভিয়েনা সন্ধি (১৮১৫ খ্রি.) ভাঙার চেষ্টা করেন।
[5] অস্ট্রিয়ার উদ্দেশ্য: অস্ট্রিয়া মনে করত যে, বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য বাড়লে অস্ট্রিয়ার স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হবে। এজন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া 'শত্রুতামূলক নিরপেক্ষতা নীতি' গ্রহণ করে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে সমর্থন করে।
[6] গ্রিক চার্চের অভিভাবকত্ব: তুরস্কের অন্তর্গত জিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান জেরুজালেমের গ্রোটোর গির্জা ও অন্যান্য কিছু পবিত্র স্থান এবং গ্রিক খিস্টান প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার রাশিয়ার হাতে দেওয়ার জন্য রুশ জার ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সুলতানের কাছে দূতের মাধ্যমে দাবি জানান। তুরস্ক এই দাবি অগ্রাহ্য করলে রাশিয়া তুরস্কের অন্তর্গত মলডেভিয়া ও ওয়ালাকিয়া প্রদেশ দুটি দখল করে নেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।
[7] ভিয়েনা নোট: রাশিয়ার আগ্রাসনে আতঙ্কিত হয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশ ভিয়েনা শহরে মিলিত হয়ে ভিয়েনা নোট বা ভিয়েনা প্রস্তাব গ্রহণ করে মোলডেভিয়া ও ওয়ালাকিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। রাশিয়া এই দাবি অগ্রাহ্য করলে তুরস্কের পক্ষে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া যুদ্ধে যোগ দেয়। ফলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
মূল্যায়ন: দু-বছর যুদ্ধ চলার পর রাশিয়া ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং প্যারিসের সন্ধির (১৮৫৬ খ্রি.) মাধ্যমে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই সন্ধির দ্বারা তুরস্কে রাশিয়ার আগ্রাসন অপসারিত হয় এবং ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি বৃহৎ শক্তিবর্গ তুর্কি সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তুরস্ককে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে আনা হয়।