অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ ইউরোপে উদারতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি প্রগতিশীল ভাবধারার অগ্রগতি প্রতিহত করতে ১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যে রক্ষণশীল ও দমনমূলক নীতি কার্যকর করেন তা সাধারণভাবে 'মেটারনিখ ব্যবস্থা' নামে পরিচিত।
মেটারনিখ ব্যবস্থার মূল্যায়ন
একদিকে মেটারনিখ ব্যবস্থার পক্ষে এবং অন্যদিকে এর বিপক্ষেও বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরা হয়। যেমন-
[1] সপক্ষে যুক্তি: মেটারনিখ ব্যবস্থার সপক্ষে প্রধান যুক্তিগুলি হল-
[i] ইউরোপের যুদ্ধজনিত অশান্তি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে মেটারনিখ অন্তত ৩০ বছরের জন্য শান্তি ও স্থিরতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। [ii] শান্তি প্রতিষ্ঠার ফলে ইউরোপে সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। [iii] বহু জাতি ও ভাষাগোষ্ঠী অধ্যুষিত অস্ট্রিয়ার ঐক্য ধরে রাখার জন্য মেটারনিখের নীতির প্রয়োজন ছিল। [iv] মেটারনিখের রক্ষণশীল নীতির পেছনে অস্ট্রিয়ার সম্রাট ফ্রান্সিস জোসেফ এবং মন্ত্রী কাউন্ট কোলেভার্ট-এর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।
[ 2] বিপক্ষে যুক্তি: মেটারনিখ ব্যবস্থার বিপক্ষে প্রধান যুক্তিগুলি হল-
[i] মেটারনিখের নীতি ছিল নেতিবাচক, সংকীর্ণ ও সংস্কারবিরোধী। [u] মেটারনিখ ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত উদারতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি আধুনিক ভাবধারাগুলির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। [iii] তিনি যুগধর্মকে অস্বীকার করে ইতিহাসের প্রগতিশীলতার স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেন। [iv] তিনি নতুন যুগের নতুন ভাবধারার সঙ্গে পুরাতনতন্ত্রের সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হন। [v] তাঁর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দক্ষতা এবং জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় তাঁর রক্ষণশীল নীতি চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ফরাসি বিপ্লব ইউরোপে প্রগতিশীল ভাবধারা নিয়ে এলেও মেটারনিখ এই স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার চেষ্টা করেন। ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস-এর মতে, মেটারনিখ হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যের মূলত দুটি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন-
[1] সামন্ত্রপ্রভু ও [2] মজুতদার পুঁজিপতি শ্রেণি।
মেটারনিখ ব্যবস্থার পতনের কারণ
মেটারনিখ ব্যবস্থার পতনের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন-
[1] নেতিবাচক নীতি: মেটারনিখের নীতি ছিল নেতিবাচক এবং সংস্কারবিরোধী। তিনি ফরাসি বিপ্লব ও উদারতন্ত্রের ধ্বংসাত্মক দিকটি দেখলেও এর গঠনমূলক দিকটি দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
[2] নতুন যুগের আগমন: উনবিংশ শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব, নগরজীবনের প্রসার, বুর্জোয়াদের প্রাধান্য প্রভৃতির ফলে নতুন যুগের আগমন ঘটে। এর সঙ্গে মেটারনিখের পুরোনো নীতি মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
[3] যুগধর্মের বিরোধিতা: ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত আধুনিক ভাবধারাগুলি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু মেটারনিখ যুগধর্মকে উপেক্ষা করে পিছিয়ে পড়া পুরানো নীতিগুলিই আঁকড়ে ধরে থাকেন।
[4] ইউরোপের বিরোধিতা: ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মেটারনিখের নীতির বিরোধিতা করে এই নীতি ত্যাগ করে। ইংল্যান্ড ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে, রাশিয়া ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ফ্রান্স ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এই নীতি থেকে সরে আসে।
[5] ফেব্রুয়ারি বিপ্লব: ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় যে ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় তা ক্রমে বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। নিরুপায় মেটারনিখ ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান। এভাবে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে।
উপসংহার: মেটারনিখ ব্যবস্থা ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ভেঙে পড়লেও অন্তত তিন দশক তাঁরই অঙুলিহেলনে ইউরোপের রাজনীতি আবর্তিত হয়। এই সময় তিনি প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয় রাজনীতির বরপুত্র হয়ে উঠেছিলেন।