ফরাসি শাসক নেপোলিয়ন শুধু সমরকুশলী যোদ্ধা হিসেবেই নয়, সুদক্ষ সংস্কারক হিসেবেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ঐতিহাসিক ফিশার বলেছেন যে, "নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য ক্ষণস্থায়ী হলেও ফ্রান্সে তাঁর অসামরিক সংস্কারগুলি গ্রানাইট পাথরের শক্ত ভিতের ওপর নির্মিত হয়েছিল।”
নেপোলিয়নের সংস্কার
নেপোলিয়নের প্রধান সংস্কারগুলি হল-
[1] শাসনতান্ত্রিক সংস্কার: নেপোলিয়ন ফ্রান্সে আইনের শাসন প্রবর্তন করেন এবং জনগণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেন। সমগ্র দেশকে ৮৩টি ডিপার্টমেন্ট বা প্রদেশে বিভক্ত করে সেখানে 'প্রিফেক্ট' নামে শাসক নিয়োগ করেন। তিনি প্রদেশগুলিকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করে সেখানে 'সাব-প্রিফেক্ট' নামে শাসক নিয়োগ করেন।
[2] অর্থনৈতিক সংস্কার: দেশের অর্থনৈতিক সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনিー[i] সরকারি ব্যয় হ্রাস ও অডিট প্রথা চালু করেন, [ii] সবাইকে আয়কর প্রদানে বাধ্য করেন, [iii] নতুন কর না চাপিয়ে পুরোনো কর আদায়ে জোর দেন, [iv] 'ব্যাংক অব ফ্রান্স' প্রতিষ্ঠা (১৮০০ খ্রি.) করেন ও [v] বাণিজ্যের উন্নতির জন্য বণিক সংঘের পুনর্গঠন করেন।
[3] শিক্ষা সংস্কার: নেপোলিয়ন-[i] ফ্রান্সে বেশ কিছু মাধ্যমিক, ফলিত বিজ্ঞান, চিকিৎসা, কারিগরি, আইন, শিক্ষক-শিক্ষণ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, [ii] ২৯টি 'লাইসি' বা আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন, [iii] 'ইউনিভার্সিটি অব ফ্রান্স' প্রতিষ্ঠা করেন (১৮০৮ খ্রি.)।
[4] ধর্মীয় সংস্কার: নেপোলিয়ন পোপ সপ্তম পায়াস-এর সঙ্গে 'কনকর্ডাট' বা 'ধর্ম-মীমাংসা চুক্তি' (১৮০১ খ্রি.) স্বাক্ষর করে পোপের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেন। এই চুক্তির দ্বারা- [i] পোপ ফরাসি গির্জা ও গির্জার সম্পত্তির জাতীয়করণ মেনে নেন, [ii] ফ্রান্স রোমান ক্যাথোলিক ধর্মমত ও গির্জাকে স্বীকৃতি দেয় এবং [iii] স্থির হয় যে, সরকার যাজকদের নিয়োগ করবে এবং পোপ তাদের স্বীকৃতি দেবে।
[5] আইনবিষয়ক সংস্কার: নেপোলিয়ন বিভিন্ন প্রদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের আইনগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ২২৮৭টি (মতান্তরে ২২৮১টি) বিধি-সম্বলিত 'কোড নেপোলিয়ন' নামে এক আইনসংহিতা প্রবর্তন করেন। এর প্রধান দিকগুলি ছিল- [i] সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি, [ii] ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি, [iii] আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, [iv] ধর্মীয় সহনশীলতা, [v] সরকারি চাকরিতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রভৃতি।
মূল্যায়ন: নেপোলিয়ন তাঁর সংস্কার কার্যাবলির দ্বারা বিপ্লব-বিধ্বস্ত ফ্রান্সে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনেন। ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেছেন যে, নেপোলিয়নের শাসন শুধু প্রজাহিতৈষীই ছিল না-তা বর্তমানকালের একনায়কতন্ত্রের তুলনায় অনেক বেশি মানবিক ছিল।