ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ জারি করে ইংল্যান্ডের অর্থনীতি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন।
নেপোলিয়নের পতনে মহাদেশীয় অবরোধের ভূমিকা
নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা বলপ্রয়োগের দ্বারা কার্যকর করতে গিয়ে বিভিন্ন সংকটে জড়িয়ে পড়েন যা তাঁর পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
যেমন-
[1] ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ক্ষতি: নেপোলিয়নের মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা পরোক্ষে ফ্রান্সের অর্থনীতিরই যথেষ্ট ক্ষতি করে। ইংল্যান্ডের 'অর্ডার্স-ইন-কাউন্সিল' নামে নৌ-প্রতিরোধের ফলে ফ্রান্সের সামুদ্রিক বাণিজ্য যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ফ্রান্সে শ্রমিক ছাঁটাই, বেকার সমস্যা প্রভৃতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তাই ঐতিহাসিক জর্জ রুডে বলেছেন যে, "মহাদেশীয় ব্যবস্থা ফ্রান্সের পক্ষে 'বুমেরাং' হয়ে দাঁড়ায়।"
[2] উপকূল দখল: নেপোলিয়ন জোর করে মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা কার্যকর করতে গিয়ে ইউরোপের উপকূল অঞ্চলের প্রায় ২ হাজার মাইল অঞ্চল দখল করে নেন। এ ছাড়া বহু নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ দেশ তিনি দখল করে নিলে বিভিন্ন দেশে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়।
[3] ব্যয়ভার: মহাদেশীয় ব্যবস্থা কার্যকর করতে গিয়ে নেপোলিয়ন যে বিস্তৃত ভূখণ্ড দখল করেন সেখানে প্রত্যক্ষ দখলদারি চালাতে গিয়ে তাঁকে সামরিক বাহিনীসহ সর্বত্র ছুটে বেড়াতে হয়। ফলে ফরাসি সেনাদল অত্যন্ত চাপে থাকে এবং বিপুল সম্পদ ব্যয় হয়।
[4] রোম ও হল্যান্ডে অসন্তোষ: রোম ও হল্যান্ড মহাদেশীয় ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করায় নেপোলিয়ন সেখানে হস্তক্ষেপ করেন। [i] তিনি রোমের শাসক পোপকে সিংহাসনচ্যুত করে তাঁকে বন্দি করলে খ্রিস্টান ক্যাথোলিক জগত প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। [ii] হল্যান্ডের শাসক লুই (নেপোলিয়নের ভাই)-কে সিংহাসনচ্যুত করে হল্যান্ড দখল করেন।
[5] উপদ্বীপের যুদ্ধে বিপর্যয়: [i] পোর্তুগাল মহাদেশীয় ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করায় নেপোলিয়ন স্পেনের অনুমতি না নিয়ে স্পেনের ওপর দিয়ে পোর্তুগালে সেনা পাঠিয়ে সেখানে মহাদেশীয় ব্যবস্থা কার্যকর করেন। [ii] পোর্তুগাল থেকে ফেরার পথে তিনি স্পেন দখল করে সেখানকার সিংহাসনে নিজের ভাই জোসেফকে বসান। এর ফলে স্পেন ও পোর্তুগাল নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে যা উপদ্বীপের যুদ্ধ (১৮০৮-১৪ খ্রি.) নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে ইংল্যান্ডও স্পেনের পক্ষে যোগ দিলে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটে।
[6] রাশিয়ায় বিপর্যয়: রাশিয়া মহাদেশীয় ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করায় নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ (১৮১২ খ্রি.) করেন। কিন্তু রাশিয়ায় তাঁর 'গ্রাঁদ আর্মি' চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং তাঁর বেশিরভাগ সৈন্য মারা যায়।
মূল্যায়ন: ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংস করতে গিয়ে নেপোলিয়ন চতুর্দিকে অসংখ্য শত্রু তৈরি করে ফেলেন এবং শেষপর্যন্ত শত্রুদের কাঁটার জালে তিনি নিজেই আটকে পড়েন। তাই বলা যায় যে, নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ ছিল মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা। ঐতিহাসিক লজ বলেছেন যে, "মহাদেশীয় ব্যবস্থা ছিল একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে নেপোলিয়নের | অযোগ্যতার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ।"