ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আদর্শ ছিল 'সাম্য', 'মৈত্রী' ও 'স্বাধীনতা'। নেপোলিয়ন ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের শাসনক্ষমতা দখল করেন এবং ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন।
বৈপ্লবিক ভাবধারা প্রতিষ্ঠা
নেপোলিয়ন তাঁর রাজত্বকালে বিপ্লবের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। যেমন-
[1] দৈব অধিকারতত্বের বিলোপ: বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজারা নিজেদের ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করতেন। নেপোলিয়ন ক্ষমতালাভের পর ফরাসি রাজতন্ত্রের ঐশ্বরিক বা দৈব অধিকারতত্ত্বের বিলোপ ঘটান। তিনি প্রাপ্তবয়স্ক সকল নাগরিককে ভোটাধিকার প্রদান করে গণ-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
[2] সাম্য প্রতিষ্ঠা: বিপ্লবের আগে ফ্রান্সে বৈষম্যমূলক শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। নেপোলিয়ন ফ্রান্সে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর হন। নেপোলিয়ন তাঁর আইনসংহিতা অর্থাৎ কোড নেপোলিয়নের দ্বারা সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটান এবং ঘোষণা করেন যে, আইনের দৃষ্টিতে দেশের সকল নাগরিক সমান।
[3] সামন্ততান্ত্রিক আদর্শের বিলোপ: বিপ্লবের আগে বুরবোঁ রাজতন্ত্র ফ্রান্সে যেসব সামন্ততান্ত্রিক রীতিনীতি ও করের প্রচলন করেছিল বিপ্লবের মাধ্যমে সেগুলি বিলুপ্ত হয়। নেপোলিয়ন নিজেকে 'সম্রাট' (১৮০৪ খ্রি.) হিসেবে ঘোষণা করেও পরে এসব সামন্ততান্ত্রিক রীতিনীতি ও করগুলি ফ্রান্সে ফিরিয়ে আনেননি।
[4] যোগ্যতার স্বীকৃতি: নেপোলিয়ন বংশকৌলীন্য বাতিল করে যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দেন। তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা দানের নিয়ম চালু করেন। এর ফলে বিপ্লবের আগে ফরাসি যাজক ও অভিজাত শ্রেণি যোগ্যতা ছাড়াই যেসব সুযোগসুবিধা ভোগ করত তা ক্রমশ বাতিল হয়ে যায়।
[5] ধর্মনিরপেক্ষতা: নেপোলিয়ন ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ গ্রহণ করেন। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে 'সিভিল কনস্টিটিউশন অব দ্য ক্লার্জি' নামক আইনের দ্বারা ফরাসি গির্জার ওপর পোপের কর্তৃত্ব লুপ্ত হলে পোপ অসন্তুষ্ট হন। নেপোলিয়ন পোপ সপ্তম পায়াস-এর সঙ্গে কনকর্ডাট বা ধর্ম-মীমাংসা চুক্তির (১৮০১ খ্রি.) মাধ্যমে পোপের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেন।
[6] বিপ্লবী আদর্শের প্রসার: নেপোলিয়ন ফ্রান্সের বাইরে বিভিন্ন দেশে বিপ্লবী আদর্শের প্রসার ঘটান। বৈদেশিক ক্ষেত্রে নেপোলিয়ন ছিলেন 'বিপ্লবের অগ্নিময় তরবারি'। তাঁর সৈন্যবাহিনী জার্মানি, ইটালি-সহ ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানোর ফল হিসেবে সেসব স্থানে পুরাতনতন্ত্র ধ্বংস হয়।
মূল্যায়ন: নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত বিভিন্ন আদর্শ বাস্তবায়িত করায় ঐতিহাসিক ফিশার তাঁকে 'বিপ্লবের সন্তান' ('Child of Revolution') বলে অভিহিত করেছেন। লেফেভর, সোরেল, ম্যাসন প্রমুখও মনে করেন যে, নেপোলিয়ন ছিলেন বিপ্লবের ধারক, বাহক ও মূর্ত প্রতীক। ঐতিহাসিক ফিলিপ গুয়েদালা বলেছেন যে, "নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বিপ্লবকে ব্যাহত করেনি, বরং বিপ্লবের প্রসার ঘটিয়েছে।"