১৮৭১ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপে বড়ো ধরনের কোনো যুদ্ধ না হলেও আপাত শান্তির আড়ালে বাতাসে বারুদের গন্ধ পাওয়া
যাচ্ছিল। শান্তির আড়ালে যুদ্ধের এই পরিস্থিতি 'সশস্ত্র শান্তির যুগ' নামে পরিচিত। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে শান্তি ভঙ্গ হয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বা মহাযুদ্ধের (১৯১৪-১৮ খ্রি.) বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন-
[1] বলকান জাতীয়তাবাদ: এশিয়ার অটোমান তুর্কি শাসকদের অধীনস্থ পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি স্বাধীনতার দাবিতে ক্রমেই সোচ্চার হয়ে ওঠে। সার্ব জাতি অধ্যুষিত বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা নামে দুটি প্রদেশ সার্বিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেও বার্লিন চুক্তির (১৮৭৮ খ্রি.) দ্বারা তাদের জোর করে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তাই প্রদেশ দুটিতে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়।
[2] উগ্র জাতীয়তাবাদ: বিংশ শতকের শুরুতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। এই সময় ইউরোপে বিভিন্ন উগ্র জাতীয়তাবাদী মতবাদের উন্মেষ ঘটে এবং ইউরোপের প্রতিটি জাতি নিজ জাতিকে শ্রেষ্ঠ এবং অন্য জাতিগুলিকে নিকৃষ্ট বলে মনে করতে থাকে। রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান প্রভৃতি দেশেও উগ্র জাতীয়তাবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে।
[3] ঔপনিবেশিক সংঘাত: ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে আগে শিল্পায়ন ঘটায় তারা এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ বিস্তারে এগিয়েছিল। জার্মানি-সহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে পরে শিল্পায়ন ঘটায় তারা সেই শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার অন্বেষনের জন্য উপনিবেশ দখল করতে গেলে অন্যদের সঙ্গে তাদের সংঘাত বেধে যায়।
[4] পরস্পর-বিরোধী শিবির: বিংশ শতকের শুরুতে ইউরোপ পরস্পর-
বিরোধী দুটি জোটে বিভক্ত হয়ে যায়-
[i] ত্রিশক্তি চুক্তি: ফ্রান্সকে নিঃসঙ্গ করে রাখার উদ্দেশ্যে জার্মানির প্রধানমন্ত্রী বিসমার্কের উদ্যোগে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইটালির মধ্যে ত্রিশক্তি চুক্তি (১৮৮২ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়।
[ii] ত্রিশক্তি আঁতাঁত: ত্রিশক্তি জোটের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার মধ্যে ত্রিশক্তি আঁতাঁত বা ত্রিশক্তি মৈত্রী গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে ক্রমশ অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
[5] ফ্রান্সের ক্ষোভ: ফ্রান্স সেডানের যুদ্ধে (১৮৭০ খ্রি.) প্রাশিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে কয়লা ও লোহার খনিসমৃদ্ধ আলসাস ও লোরেইন নামক স্থান দুটি জার্মানিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ এবং আলসাস ও লোরেইন পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে ফ্রান্স জঙ্গি মনোভাব নিয়ে জার্মান-বিরোধী জোট তৈরি করে এবং ইউরোপে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে।
[6] অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ: ঊনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে ইউরোপের বিভিন্ন জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে সোচ্চার হয়। আলসাস ও লোরেইন পাওয়ার জন্য ফরাসিরা, ট্রিয়েস্ট ও ট্রেনটিনো পাওয়ার জন্য ইতালীয়রা, শ্লেসউইগ পাওয়ার জন্য ডেনরা, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডবাসী আন্দোলন শুরু করে।
[7 ] জার্মানির নৌশক্তি বৃদ্ধি: নতুন উপনিবেশ দখলের জন্য জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম বিশাল জার্মান নৌবহর গঠনের কাজে হাত দেন। এতে আতঙ্কিত হয়ে ইংল্যান্ডও পালটা নৌশক্তি বৃদ্ধি শুরু করে।
[৪] জার্মানির আগ্রাসী নীতি: কাইজারㅡ[1] বিসমার্কের স্থিতাবস্থার নীতি ত্যাগ করে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি বাতিল (১৮৯০ খ্রি.) করেন, [Ⅱ] রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার আগ্রাসনে উৎসাহ দেন, [II] ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় বিদ্রোহী বোয়ার-এর প্রেসিডেন্ট ক্রুগারকে সমর্থন করেন এবং [iv] বার্লিন-বাগদাদ রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন।
[9] মরক্কো সংকট: ফ্রান্স আফ্রিকার মরক্কোয় উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করলে জার্মান কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মরক্কোর সুলতানের পাশে দাঁড়ান এবং 'প্যান্থার' নামে একটি যুদ্ধজাহাজকে মরক্কোর আগাদির বন্দরে ঢুকিয়ে দেন। ফলে ফ্রান্স ও জার্মানির সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
10] সেরাজেভোর হত্যাকাণ্ড: অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়া সার্ব জাতি অধ্যুষিত বসনিয়া সফরে এলে (১৯১৪ খ্রি.) তারা সেরাজেভো শহরে এক বসনীয় ছাত্রের হাতে নিহত হন (২৮ জুন)। অস্ট্রিয়া এই হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র সার্বিয়াকে দায়ী করে বিভিন্ন কঠোর শর্তাদি সহ একটি চরমপত্র পাঠায়।
মূল্যায়ন: অস্ট্রিয়ার চরমপত্রের কিছু শর্ত মানলেও অবশিষ্ট শর্তগুলির বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক বৈঠক ডাকার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু অস্ট্রিয়া এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড আক্রমণ করে। কিছুদিনের মধ্যে ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরের বিভিন্ন রাষ্ট্র ভিন্ন ভিন্ন বিবদমান পক্ষে যোগ দিলে তা বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়।