অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে প্রথমে ইংল্যান্ডে এবং পরে ইউরোপের অন্যান্য দেশে যন্ত্রচালিত কলকারখানায় শিল্পোৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এই ঘটনা শিল্পবিপ্লব নামে পরিচিত।
শিল্পবিপ্লবের ফলাফল
ইংল্যান্ড তথা ইউরোপীয় অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিল্পবিপ্লবের ব্যাপক ও গভীর ফলাফল লক্ষ করা যায়। যেমন-
[1] শিল্প-অর্থনীতির বিকাশ: শিল্পবিপ্লবের ফলে পুরোনো কৃষিনির্ভর অর্থনীতি দ্রুত শিল্প-বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়। শিল্পোৎপাদনের ব্যাপক হারে বৃদ্ধির ফলে বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।
[2] ফ্যাক্টরি প্রথার উদ্ভব: শিল্পবিপ্লবের ফলে শহরাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করে বহু শিল্পকারখানা গড়ে তোলায় শিল্পক্ষেত্রে ফ্যাক্টরি প্রথার উদ্ভব ঘটে।
[3] পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ: ধনী শিল্পপতিরা তাদের কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বিদেশের বাজারে অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ক্রমে এই ধনী পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভব হয়।
[4] মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব: শিল্পবিপ্লবের ফলে একদিকে প্রচুর অর্থসম্পদের অধিকারী পুঁজিপতি মালিকশ্রেণি এবং অন্যদিকে চালচুলোহীন শোষিত শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব ঘটে।
[5] শ্রমিকদের শোষণ: শ্রমিকরা সামান্য মজুরির বিনিময়ে কারখানাগুলিতে প্রতিদিন ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হত। অথচ এর বিনিময়ে তারা খুব সামান্য মজুরি পেত। ফলে তাদের জীবন অভাবে-অনটনে জর্জরিত হয়ে উঠেছিল। কার্ল মার্কস বলেছেন, "সূর্যালোকিত দিনের মাঝে শ্রমিকদের জীবন ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন।"
[6] মালিকশ্রেণির আধিপত্য: অভিজাত ও ভূস্বামীশ্রেণি শিল্পবিপ্লবের আগে একচেটিয়া রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করত। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীকালে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা অতি দ্রুত বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে উঠলে অর্থসম্পদের জোরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
[7] উপনিবেশ স্থাপন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা: কাঁচামাল সংগ্রহ এবং পণ্য বিক্রির জন্য বাজার দখলের প্রয়োজনে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অনুন্নত অঞ্চলে উপনিবেশ দখল শুরু করে। কিন্তু উপনিবেশের সংখ্যা সীমিত হওয়ায় তা দখলের জন্য বিভিন্ন শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।
[৪] গ্রাম্য জীবনের অবক্ষয়: শিল্পবিপ্লবের পর গ্রামের বহু মানুষ নগদ বেতনে কাজের প্রত্যাশায় শহরের শিল্পাঞ্চলগুলিতে চলে আসতে থাকে। ফলে গ্রাম্য জীবনে এক অভূতপূর্ব অবক্ষয় শুরু হয় এবং আগেকার প্রাণচঞ্চল গ্রামগুলি হতশ্রী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, নগর জীবনের দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে।
[9] সামাজিক অস্থিরতা: শিল্পবিপ্লবের ফলে গ্রামের কুটির- শিল্প
সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। আবার মালিক পক্ষ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে শ্রমিকদের কর্মচ্যুত করলে তাদের জীবনে ভয়ংকর দুর্দশা নেমে আসে। এই অবস্থায় কারখানার যন্ত্রগুলিকে তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলি ভাঙার জন্য দাঙ্গা বাধায়। এভাবে ইংল্যান্ডে লুডাইট দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।
[10] শ্রমিক আন্দোলন: সীমাহীন অবিচার ও শোষণের শিকার হয়ে শ্রমিকরা উপলব্ধি করে যে, সাধারণ উপায়ে তারা শোষণ থেকে মুক্তি ও অধিকার আদায় করতে পারবে না। তাই তারা মালিকশ্রেণি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
মূল্যায়ন: রবার্ট ওয়েন, সাঁ সিমোঁ, শার্ল ফুরিয়ের প্রমুখ সমাজতন্ত্রী শোষিত শ্রমিকশ্রেণির সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা প্রচার করে তাদের বলেন যে, সমাজতন্ত্রই হল শোষণ থেকে মুক্তির পথ। কার্ল মার্কস শিল্পোৎপাদনে মালিক ও শ্রমিকদের সমান অধিকার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপের দাবি করেন। এভাবে ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।