১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সেডানের যুদ্ধে জার্মানির কাছে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটে। এরপর ইউরোপীয় রাজনীতিতে ফ্রান্সকে মিত্রহীন করে রাখার উদ্দেশ্যে জার্মান প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক এক শক্তিশালী জোট গড়ে তোলেন। জার্মানি, ইটালি ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা এই জোট 'ত্রিশক্তি চুক্তি' বা 'ট্রিপ্ল এলায়েন্স' নামে পরিচিত।
'ত্রিশক্তি চুক্তি' বা 'ট্রিপল-এলায়েন্স' গঠন
ইউরোপে 'ত্রিশক্তি চুক্তি' বা 'ট্রিপ্ল এলায়েন্স' গঠনের প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ-
[1] তিন সম্রাটের চুক্তি: ইউরোপে জার্মান-বিরোধী জোট গঠন প্রতিহত করা এবং ফ্রান্সকে নিঃসঙ্গ করে রাখার উদ্দেশ্যে বিসমার্কের উদ্যোগে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়াকে নিয়ে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে 'তিন সম্রাটের চুক্তি' বা 'ড্রাইকাইজারবুন্ড' গড়ে ওঠে।
[2] দ্বিশক্তি চুক্তি: বলকান সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে বিসমার্কের নেতৃত্বে বার্লিন কংগ্রেস (১৮৭৮ খ্রি.) অনুষ্ঠিত হয়। বার্লিন চুক্তিতে রাশিয়া বিসমার্কের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে 'তিন সম্রাটের চুক্তি' ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ফলে তিন সম্রাটের চুক্তি ভেঙে যায় এবং বিসমার্ক জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে দ্বিশক্তি চুক্তি (১৮৭৯ খ্রি.) বা ভিয়েনা সন্ধি গড়ে তোলেন।
[3] তিন সম্রাটের লিগ: বিসমার্ক উপলব্ধি করেন, জার্মানির সঙ্গে রাশিয়ার দূরত্ব বাড়লে ফ্রান্সের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাবে। তাই তাঁর উদ্যোগে (১৮৮১ খ্রি.) জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে 'তিন সম্রাটের লিগ' বা 'ড্রাইকাইজারবুন্ডনিস' স্থাপিত হয়। এতে ঠিক হয় যে, চুক্তিবদ্ধ তিনটি রাষ্ট্রের কেউ চতুর্থ কোনো শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হলে অপর দুই রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে।
[4] ত্রিশক্তি চুক্তি: বিসমার্ক তিন সম্রাটের লিগে ইটালিকে যুক্ত করার চেষ্টা চালান। ইতিমধ্যে উত্তর আফ্রিকার টিউনিস দখলকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স ও ইটালির মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বিসমার্ক সহজেই ইটালিকে দলে টানতে সক্ষম হন। তাঁর উদ্যোগে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে (২০ মে) অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইটালির মধ্যে 'ত্রিশক্তি চুক্তি' বা 'ট্রিপ্ল এলায়েন্স' গড়ে ওঠে। বিসমার্ক পরে রোমেনিয়া ও তুরস্ককে এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে চুক্তিটিকে আরও সম্প্রসারিত করেন।
[5] ত্রিশক্তি চুক্তির শর্তাবলি: ত্রিশক্তি চুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে- [1] ফ্রান্স ইটালিকে আক্রমণ করলে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া ইটালির পক্ষে যোগ দেবে। [Ⅱ] ফ্রান্স জার্মানিকে আক্রমণ করলে ইটালি জার্মানির পক্ষে যোগ দেবে। [] অস্ট্রিয়া ও জার্মানির মধ্যে কোনো বিরোধ বাধলে ইটালি নিরপেক্ষ থাকবে।
মূল্যায়ন: অধ্যাপক সীম্যান মনে করেন যে, ত্রিশক্তি চুক্তি ছিল ইউরোপে বিসমার্কের সাফল্য ও প্রভাবের চূড়ান্ত প্রতীক। এর দ্বারা বিসমার্ক একদিকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে ফ্রান্সকে নিঃসঙ্গ করেন, অন্যদিকে জার্মানির নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেন। ঐতিহাসিক কেটেলবি মন্তব্য করেছেন যে, বিসমার্ক সর্বদা পাঁচটি বল নিয়ে খেলতেন-তিনটি বল নিজের হাতে, দুটি বল শূন্যে রাখতেন।