ভারতের জলসেচ (Irrigation of India)
ভারতের অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর এবং ভারতের কৃষিজমির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। জলসেচ ব্যবস্থা ভারতে মৌসুমি বৃষ্টির ওপর কৃষিকাজের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে এবং শস্যের উৎপাদন, খাদ্যসুরক্ষা ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারতে জলসেচের প্রয়োজনীয়তা (Necessity of Irrigation in India)
ভারতে জলসেচের প্রয়োজনীয়তাগুলি হল- (i) ভারতীয় কৃষি অনেকাংশে বৃষ্টিপাতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং ভারতে প্রায় 75% বৃষ্টিপাতই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সংঘটিত হয়। কিন্তু মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমন অনিশ্চিত হওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে জলের প্রাপ্যতার বিষয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। (ii) সারাবছরব্যাপী ফসল উৎপাদনের জন্য জলসেচের প্রয়োজন। (iii) বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ক্ষেত্রে যথেন্ট তারতম্য লক্ষ করা যায়। (iv) সবুজ বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় জলসেচের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ উচ্চফলনশীল বীজ থেকে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রচুর পরিমাণে জল প্রয়োজন হয়। (v) ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে খাদ্য সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জলসেচের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। (vi) অকর্ষণযোগ্য ভূমিভাগকেও জলসেচের মাধ্যমে কৃষিজমিতে পরিণত করা সম্ভব হচ্ছে। (vii) শীতকালে খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য জলসেচের প্রয়োজন হয়। (viii) ভারতের যেসব মাটিতে জলধারণ ক্ষমতা কম (যেমন-ল্যাটেরাইট বা লোহিত মুক্তিকা) সেখানে জলসেচের সাহায্য ছাড়া কৃষিকাজ সম্ভব নয়।
জলসেচের অনুকূল শর্তাবলি (Favourable Conditions of Irrigation)
ভারতে জলসেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত শর্তগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য-(i) নদীবিধৌত সমভূমি ও উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চলে সহজেই সেচখাল খনন করা যায়। (ii) উত্তর ভারতের অসংখ্য তুষারগলা জলে পুষ্ট নদী থেকে খুব সহজে নিত্যবহ খাল খনন করা যায়। (iii) দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চলের কঠিন শিলা দ্বারা গঠিত ভূমিভাগে বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করা সম্ভব হয়। (iv) সমভূমি অঞ্চলের সমঢালযুক্ত স্থানে জলসেচ করা সহজসাধ্য হয়। (v) বর্ষাকালে নদীসহ বিভিন্ন জলাশয়গুলি পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক ঋতুতে এগুলি থেকে সেচের ব্যবস্থা করা যায়। (vi) নদীবিধৌত সমভূমি অঞ্চলে ভৌম জলস্তর ভূপৃষ্ঠের খুব কাছে অবস্থান করায় অনেক কূপ ও নলকূপ গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
জলসেচের বিভিন্ন কৌশল (Different Techniques of Irrigation)
ভারতে ভূপ্রকৃতি, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, ভৌম জলস্তরে অবস্থান, মৃত্তিকার প্রকৃতি, নদনদীর বিন্যাস প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন অঞ্চলে জলসেচের বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করতে দেখা যায়। নীচে উল্লিখিত পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে ভারতে সাধারণত জলসেচ করা হয়।
জলাশয় সেচ (Tank Irrigation)
ভারতের দক্ষিণের মালভূমি অঞ্চলের তরঙ্গায়িত ভূমিভাগের অনেক নীচু অংশে বৃষ্টির জল সঞ্চিত হয়ে জলাশয় গড়ে তোলে। এ ছাড়া ভারতের পূর্বে বিভিন্ন জলাশয় যেমন- পুকুর, হ্রদ প্রভৃতি থেকে জল উত্তোলনের মাধ্যমেও জলসেচ করা যায়। সেচসেবিত
অঞ্চলসমূহ: ভারতের দক্ষিণে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে বহুল পরিমাণে এবং পূর্বদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, অসম প্রভৃতি রাজ্যে সামান্য পরিমাণে জলাশয়ের মাধ্যমে জলসেচ করা হয়। এই পদ্ধতিতে সেচকার্যে অস্ত্রপ্রদেশ প্রথম (503 হাজার হেক্টর) ও তামিলনাড়ু (620 হাজার হেক্টর) দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী। কৌশল: জলাশয়গুলি থেকে পাম্প, ডোঙা প্রভৃতির মাধ্যমে জল উত্তোলন করে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হয়।
• শ্রেণিবিভাগ: জলাশয় প্রধানত দুই প্রকার। যেমন-(a) প্রাকৃতিক জলাশয় ও (b) কৃত্রিম জলাশয়।
(a) প্রাকৃতিক জলাশয় (Natural Tank): প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট বিল, পুকুর, দিঘি প্রভৃতি জলাশয়কে প্রাকৃতিক জলাশয় বলে। (b) কৃত্রিম জলাশয় (Artificial Tank): আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে বা নদী সংলগ্ন স্থানে মৃত্তিকা খনন করে কৃত্রিম উপায়ে যে জলাশয় সৃষ্টি করা হয়, তাকে কৃত্রিম জলাশয় বলে।
• সুবিধাঃ (1) শক্ত শিলা দ্বারা গঠিত অঞ্চলে নলকূপ খননের সমস্যা থাকায় জলাশয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। (ii) জলাশয়গুলির স্থায়িত্ব যথেষ্ট বেশি। (iii) প্রাকৃতিক জলাশয়গুলির ক্ষেত্রে কোনোরূপ নির্মাণ ব্যয় নেই।
অসুবিধা: (1) পলি সঞ্চয়ের ফলে জলাশয়গুলির গভীরতা হ্রাস পায়। (ii) শুষ্ক ঋতুতে বা বৃষ্টিপাত খুব কম হলে জলাশয়ের জলের পরিমাণ হ্রাস পায়। (iii) বর্ষাকালে অনেক সময় জলাশয়গুলিতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত জল এসে পড়ায় প্লাবনের সৃষ্টি হয়। (iv) জলাশয় সংস্কারসাধন যথেষ্ট ব্যয়বহুল একটি পদ্ধতি।
কূপ ও নলকূপ সেচ (Well and Tubewell Irrigation)
ভারতের যেসব স্থানে ভূপৃষ্ঠের খুব কাছে ভৌম জলস্তর অবস্থান করে সেখানে তৌমজল উত্তোলনের মাধ্যমে জলসেচ করার জন্য কূপ ও নলকূপ তৈরি করা হয়। সেচসেবিত অঞ্চলসমূহ: কূপের সাহায্যে প্রধানত সর্বাধিক সেচকাজ হয় উত্তরপ্রদেশে (প্রায় 28.6%), দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাজস্থান (প্রায় 10.7%) এবং তৃতীয় স্থানে আছে পাঞ্জাব (প্রায় 9.2%)। এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, বিহার, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে কূপের মাধ্যমে জলসেচ করা হয়। অন্যদিকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার প্রভৃতি রাজ্যেও জলসেচের ক্ষেত্রে নলকূপের ব্যবহার যথেষ্ট মাত্রায় লক্ষ করা যায়। উত্তর ভারতে নলকূপের মাধ্যমে সেচের প্রচলন অপেক্ষাতে বেশি দেখা যায়। দক্ষিণ ভারতে কঠিন শিল্পস্তর, তরঙ্গায়িত ভূমিভাগ ও ভৌমজলের অধিক গভীরতায় অবস্থান প্রভৃতি কারণে। কৌশল: প্রাচীনযুগ থেকে ভারতে কূপ ও নলকূপের ব্যবহার প্রচলিত। (a) কূপ (Well): (i) সাধারণ কূপ থেকে কপিকলের সাহায্যে জল তোলা যায়। (ii) প্রাচীন পদ্ধতির ক্ষেত্রে টিনের বিশাল পাত্র বা মোষের চামড়া দিয়ে তৈরি থলির সাহায্যে জল তোলা হয়। (iii) পার্সিয়ান হুইল পদ্ধতিতে পশুশ্রমের সাহায্যে একটি চাকার গায়ে লাগানো বালতিগুলিকে ঘোরানো হয় এবং বালতি করে জল ওপরে তোলা হয়। (b) নলকূপ (Tubewell): নলকূপকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- (i) অগভীর নলকূপ (Shallow Tubewell): অগভীর প্রকৃতির নলকূপ থেকে পাম্প করে অথবা হাতের সাহায্যে জল তোলা হয়ে থাকে। (ii) গভীর নলকূপ (Deep Tubewell): ডিজেল চালিত পাম্প বা বৈদ্যুতিক পাম্পের মাধ্যমে গভীর নলকূপ থেকে সেচের জল তোলা হয়।
সুবিধা: (i) ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের নরম পলিমাটিতে খুব সহজেই কূপ ও নলকূপ খনন করা হয়। (ii) যথেষ্ট সুলভ ও সহজ পদ্ধতি হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেশি। (iii) নদী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত জমিতে এই পদ্ধতিতে জলসেচ করা যায়। (iv) জলের অপচয় খুব কম হয়। (ⅳ) প্রয়োজন অনুযায়ী জল উত্তোলন করার স্বাধীনতা এই পদ্ধতিতে থাকে। (vi) মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধিকারী বহু রাসায়নিক পদার্থ ভৌমজলের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় নলকূপের মাধ্যমে উঠে আসে এবং মৃত্তিকায় অবস্থান করে।
অসুবিধা: (i) নলকূপের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয়ভাবে জল তোলা হয়। (ii) কূপের জলে লবণের পরিমাণ বেশি থাকায় জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা যায়। (iii) কূপ বা নলকূপের সাহায্যে অতিরিক্ত মাত্রায় জল উত্তোলনের ফলে ভৌম জলস্তরের উচ্চতা হ্রাস পায়। (iv) একটি নলকূপের সাহায্যে 1-9 হেক্টর জমির বেশি জলসেচ করা সম্ভব হয় না। (v) দাক্ষিণাত্যের কঠিন শিলা দ্বারা গঠিত ভূমিভাগে নলকূপ ও কূপ খনন করা ব্যয়বহুল ও পরিশ্রম সাপেক্ষ।
খাল দ্বারা সেচ (Canal Irrigation)
■ আন্তঃঅববাহিকা জল স্থানান্তর (Inter-Basin Water Transfer): দেশের বিভিন্ন নদীর মধ্যে আন্তঃ-সংযোগের ফলে উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে ঘাটতি অঞ্চলের দিকে জলের জোগান দেওয়া সম্ভব হয়। 'ভারতে এই ক্ষেত্রে দুটি প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। (1) 1972-এ ড. কে. এল রাও-এর প্রস্তাবিত National Water Grid (2) 1977-এ ক্যাপটেন ডি জে. দস্তুর-এর Garland Canal। উদাহরণ: গ্যা-কাবেরী সংযোগ।
ভারতে যেসব নদী সংলগ্ন অঞ্চলে ভূমির ঢাল কম সেখানে খাল দ্বারা সেচ পদ্ধতিতে কৃষিজনিত জল সরবরাহ করা হয়। প্লাবন ও নিত্যবহ খাল এবং খালসেচ পদ্ধতির গুরুত্ব ও সমস্যা সম্পর্কে পূর্বে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। উত্তর ভারতে বিশাল সমতলভূমি, কোমল পলি মাটি, অসংখ্য নদনদী এবং বিভিন্ন বহুমুখী পরিকল্পনার অবস্থান থাকায় খালসেচ পদ্ধতির প্রচলন যথেষ্ট মাত্রায় লক্ষ করা যায়।
ভারতে জলসেচ ব্যবস্থার ফলাফল (Effects of Irrigation System in Indrat
• সুপ্রভাব: (1) শীতকালীন ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। (2) উচ্চফলনশীল বীজ চাষ করা সহজসাধ্য হওয়ায় কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। (3) কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষিভিত্তিক শিল্পের (যেমন-কার্পাস বয়ন শিল্প প্রভৃতি) উন্নতি ঘটেছে। (4) পতিত জমিগুলিতে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।
• কুপ্রভাব: (1) বর্ষার সময় খালের অতিরিন্ত জল দুকূল ছাপিয়ে প্লাবন সৃষ্টি করে। (2) অতিরিক্ত মাত্রায় জলসেচের কারণে ভূ-অভ্যন্তরস্থ লবণ মৃত্তিকার উপরিস্তরে জমা হয়ে মৃত্তিকার উর্বরতা নষ্ট করে। (3) জলসেচ ব্যবস্থার প্রসারের ফলে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার বিভিন্ন স্থানে একই জমিতে সারাবছর ধরে একই শস্য উৎপাদন করা হচ্ছে, যার ফলে মুত্তিকার উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে।
জলসেচের অধীন অঞ্চলসমূহ (Irrigated Region)
ভারতে পৃথিবীর সর্বাধিক পরিমাণ সেচসেবিত জমির অবস্থান রয়েছে। ভারতে 2012-13 খ্রিস্টাব্দে 15628 হাজার হেক্টর জমিতে খাল সেচ, 1748 হাজার হেক্টর জমিতে জলাশয় সেচ, 30497 হাজার হেক্টর জমিতে নলকূপ ও 10764 হাজার হেক্টর। জমিতে কূপের মাধ্যমে জলসেচ করা হয়। ওই বছরে ভারতের নোট সেচসেবিত অঞ্চলের আয়তন ছিল 66103 হাজার হেক্টর।