বুদ্ধিবাদের বিভিন্ন রূপ
বুদ্ধিবাদ অনুসারে বুদ্ধি হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস। বুদ্ধিকে যাঁরা জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকার করেন, তাঁদের বলা হয় বুদ্ধিবাদী দার্শনিক। বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের আবার দুটি রূপ দেখা যায়—[1] চরমপন্থী এবং [2] নরমপন্থী।
চরমপন্থী বুদ্ধিবাদের ধারণা:
চরমপন্থী বুদ্ধিবাদ অনুসারে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস। অর্থাৎ, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা ছাড়া জ্ঞানের দ্বিতীয়
আর কোনো উৎস নেই। চরমপন্থী বুদ্ধিবাদ বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা ছাড়া জ্ঞানের অপরাপর উৎসগুলিকে অস্বীকার করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চরম বুদ্ধিবাদী দার্শনিকগণ ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতার বিষয়টিকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ানুভবের কোনো মূল্যই স্বীকার করেন না। চরমপন্থী বুদ্ধিবাদীদের অন্যতম হলেন
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক পারমিনাইডিস, সক্রেটিস, প্লেটো, জার্মান দার্শনিক ভলফ এবং ফরাসি দার্শনিক রেঁনে দেকার্ত প্রমুখ। তাঁরা সকলেই দাবি করেন যে, আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিয়ত ও শাশ্বত সত্যের জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। নিত্য ও শাশ্বত সত্যের জ্ঞান লাভ করতে হলে কেবল বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার ওপরই নির্ভর করতে হয়।
অর্থাৎ, প্রজ্ঞা বা বুদ্ধিই কেবল প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান দিতে পারে। অভিজ্ঞতা তথা ইন্দ্রিয় সংবেদন তা কখনোই পারে না। তাঁরা আরও বলেন যে, অতীন্দ্রিয়
সত্তা বা জগৎ সম্পর্কিত জ্ঞান কখনোই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লভ্য নয়, তাকে লাভ করতে হয় বুদ্ধির মাধ্যমে। সুতরাং, চরমপন্থী বুদ্ধিবাদের বিষয়টিকে এই একটিমাত্র সূত্রের মাধ্যমেই ব্যক্ত করা যায় যে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই হল আমাদের জ্ঞানের একমাত্র উৎস।
নরমপন্থী বুদ্ধিবাদের ধারণা:
নরমপন্থী বুদ্ধিবাদ অনুসারে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা হল জ্ঞানের প্রধান উৎস। অর্থাৎ, নরমপন্থী বুদ্ধিবাদীরা বুদ্ধিকে জ্ঞানের মূল উৎসরূপে স্বীকার করলেও, কখনোই বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাকে তাঁরা জ্ঞানের একমাত্র উৎসরূপে দাবি করেন না। তাঁদের মতে, বুদ্ধি ছাড়া জ্ঞানের অন্য কোনো উৎসও থাকতে পারে। অবশ্য তাঁরা এও বলেন যে, বুদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো উৎস থাকলেও, তার দ্বারা নিম্নমানের জ্ঞানই পাওয়া যায়, কখনও উন্নতমানের জ্ঞান পাওয়া যায় না। উন্নতমানের জ্ঞান লাভ করতে হলে তাই অবশ্যই বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করতে হয়। উন্নতমানের আবশ্যিক ও সার্বিক সত্যের জ্ঞান কখনোই বুদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো উৎসের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। নরমপন্থী বুদ্ধিবাদীদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমান্যুয়েল কান্ট।
প্রকৃত নরমপন্থী বুদ্ধিবাদী হিসেবে কান্ট:
চরমপন্থী ও নরমপন্থী বুদ্ধিবাদীদের বিভাজন করা হলেও এ কথা স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে, একমাত্র কান্টই হলেন নরমপন্থী বুদ্ধিবাদের মূল প্রবক্তা। কারণ, একমাত্র তিনিই জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা—উভয়ের ভূমিকাকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর মতে, জ্ঞানের উপাদান (matter) আহরিত হয় অভিজ্ঞতার দ্বারা। আর জ্ঞানের আকার (form) দেওয়া হয় বুদ্ধির দ্বারা। জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে একটি ছাড়া আর-একটির অস্তিত্ব তাই নিরর্থক। সুতরাং, একমাত্র কান্ট ছাড়া আর বেশিরভাগ বুদ্ধিবাদী দার্শনিকই হলেন চরমপন্থী বুদ্ধিবাদী।