চরমপন্থী ও নরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদের ধারণা
অভিজ্ঞতাবাদের মূল কথা হল অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের মূল উৎস। অর্থাৎ, মূলত অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই আমরা জ্ঞান লাভ করে থাকি। কিন্তু অভিজ্ঞতার প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকগণ কখনোই ঐকমত্য পোষণ করেন না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অভিজ্ঞতাবাদের দুটি রূপ লক্ষ করা যায়-চরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদ (extreme empericism) এবং নরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদ (moderate empericism)।
চরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদ:
চরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদ তথা দৃষ্টিবাদ অনুযায়ী আমাদের সমস্তপ্রকার জ্ঞানের একমাত্র উৎস হল ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতা। এই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ছাড়া আমরা আর অন্য কোনোভাবেই জ্ঞান লাভ করতে পারি না। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ানুভব ছাড়া জ্ঞানলাভের আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। চরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদের আদি প্রবক্তা হলেন ফ্রান্সিস। বেকন। এই মতবাদটি চরম পরিণতি পায় জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্যে।
[1] জ্ঞানমাত্রেই ইন্দ্রিয় সংবেদনজাত:
চরমপন্থী মিল দাবি করেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতাই হল আমাদের সমস্তপ্রকার জ্ঞানের উৎস। তাঁর মতে, ইন্দ্রিয় সংবেদন ছাড়া আমরা আর অন্য কোনোভাবেই জ্ঞান লাভ করতে পারি না। তিনি আরও দাবি করেন যে, বাস্তব ঘটনা সংক্রান্ত জ্ঞান, যুক্তিবিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান এবং গাণিতিক জ্ঞান-সমস্ত কিছুই উৎপন্ন হয় ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতা থেকে।
[2] সব জ্ঞানই প্রকৃতিতে পরতঃসাধ্য এবং পদ্ধতিতে আরোহী:
চরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক মিল উল্লেখ করেন যে, আমাদের সমস্ত জ্ঞান এক প্রকারের এবং তা হল অভিজ্ঞতালব্ধ বা পরতঃসাধ্য। এই ধরনের জ্ঞান কখনোই নিশ্চিতরূপে গণ্য হতে পারে না। ফলে, আমাদের সমস্ত জ্ঞানই হল আপতিক, যা সত্যও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। আবশ্যিক বা অপরিহার্য নিশ্চিত জ্ঞান বলে কোনো কিছুই নেই। এমনকি গাণিতিক ও যুক্তিবিজ্ঞানের জ্ঞানও আবশ্যিক নয়। এগুলি হল অভিজ্ঞতার সামান্যীকরণের ফল। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, আমাদের জ্ঞানলাভের পদ্ধতিই হল আরোহী (inductive), কখনোই তা অবরোহী (deductive) নয়।
নরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদ:
নরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদ অনুযায়ী অভিজ্ঞতা জ্ঞানের উৎসরূপে গণ্য হলেও, জ্ঞানলাভের অন্য পথও রয়েছে। অর্থাৎ, অভিজ্ঞতা ছাড়াও বুদ্ধিকে তাঁরা জ্ঞানলাভের অন্য পন্থারূপে স্বীকার করেন। নরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদ অনুসারে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বাহ্যজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হলেও, সমস্তপ্রকার জ্ঞানই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ, সমস্তপ্রকার জ্ঞানের উৎসরূপে একমাত্র ইন্দ্রিয়ানুভবই গ্রাহ্য, এই মত কখনোই গ্রহণীয় হতে পারে না। কোনো কোনো জ্ঞান তাই বুদ্ধির মাধ্যমেও লাভ করা যায়। যুক্তিবিজ্ঞান এবং গণিতের জ্ঞানগুলি অবশ্যই বুদ্ধিলব্ধরূপে গণ্য।
নরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদ অনুযায়ী আমাদের জ্ঞান মূলত দু-প্রকার- [1] আবশ্যিক সার্বিক জ্ঞান এবং [2] আপতিক জ্ঞান। আবশ্যিক সার্বিক জ্ঞানরূপে উল্লেখ করা হয় ধারণার সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞানগুলিকে, যেগুলি বিশুদ্ধ বুদ্ধি দ্বারা লাভ করা যায়। এই সমস্ত জ্ঞানের বিরুদ্ধ বিষয়কে স্বীকার করে নিলে স্ববিরোধিতা দেখা দেয়। এগুলি তাই সত্যরূপেই গণ্য। এরকম জ্ঞানের সত্যতাকে অভিজ্ঞতার দ্বারা যাচাই করা যায় না। কিন্তু আপতিক জ্ঞানগুলিকে অবশ্যই অভিজ্ঞতার দ্বারা যাচাই বা বিচার করা যায় এবং সেকারণেই বিচারের ফল অনুযায়ী সেগুলি সত্যও হতে পারে, আবার মিথ্যাও হতে পারে।