চরমপন্থী বুদ্ধিবাদ
জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত মতবাদগুলির মধ্যে বুদ্ধিবাদ হল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। এরূপ মতবাদ অনুসারে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই হল জ্ঞানলাভের মৌল উৎস। অবশ্য বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাকেই জ্ঞানের উৎসরূপে স্বীকার করে নিলেও, সমস্ত বুদ্ধিবাদী দার্শনিক এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন না। এই মতভেদের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিবাদের দুটি রূপ লক্ষ করা যায়-চরমপন্থী বুদ্ধিবাদ এবং নরমপন্থী বুদ্ধিবাদ।
চরমপন্থী বুদ্ধিবাদের মূল বক্তব্য:
চরমপন্থী বুদ্ধিবাদ অনুসারে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস। অর্থাৎ, এরূপ মতবাদে বুদ্ধি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো জ্ঞানের উৎসকে স্বীকার করা হয় না। চরমপন্থী বুদ্ধিবাদ অনুসারে ইন্দ্রিয় সংবেদনলব্ধ জ্ঞান তথা অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞানকে একেবারেই স্বীকার করা হয়নি। চরমপন্থী বুদ্ধিবাদীদের মতে, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল। যে জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল, সেই জগৎ থেকে কোনো নিত্য ও শাশ্বত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং, অভিজ্ঞতা কখনোই জ্ঞানের উৎসরূপে গণ্য হতে পারে না। নিত্য, শাশ্বত ও যথার্থ জ্ঞানের উৎসরূপে শুধু বুদ্ধিই বিবেচ্য হতে পারে। চরম বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের অন্যতম হলেন পারমিনাইডিস, সক্রেটিস, প্লেটো, ভলফ এবং দেকার্ত, স্পিনোজা এবং লাইবনিজ প্রমুখ।
চরমপন্থী বুদ্ধিবাদীদের অভিমত:
প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ভলফের মতবাদেই চরম বুদ্ধিবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি দাবি করেন যে, আমাদের মনে কিছু সহজাত বা আন্তর ধারণা থাকে এবং এগুলির দ্বারাই আমরা আত্মা, ঈশ্বর, জগৎ প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হই। তিনি অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞানকে পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করেছেন। প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটোও উল্লেখ করেছেন যে, আমাদের যথার্থ জ্ঞানের জগৎ হল ধারণার জগৎ। কারণ, ধারণার মাধ্যমেই আমরা সার্বিক ও সত্য জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হই। আর এই ধারণা লাভ করা যায় শুধু বুদ্ধি দ্বারা, কখনোই অভিজ্ঞতার দ্বারা নয়। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক প্রখ্যাত বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেঁনে দেকার্তকেও অনেকে চরমপন্থী বুদ্ধিবাদী দার্শনিকরূপে উল্লেখ করেন। কারণ, তাঁর মতে, যথার্থ জ্ঞানের পদ্ধতি হল গণিতের পদ্ধতি এবং আরোহাত্মক পদ্ধতি। আর এরূপ পদ্ধতি শুধু বুদ্ধির মাধ্যমেই লাভ করা যেতে পারে, কখনোই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নয়। দেকার্তের পরবর্তী চরম বুদ্ধিবাদীরূপে উল্লেখ করা যায় স্পিনোজার নাম। তিনি দাবি করেন যে, আমাদের সমস্ত জ্ঞানের উৎস হল বিশুদ্ধ বুদ্ধি এবং এ ছাড়া জ্ঞানের আর কোনো উপায় নেই। স্পিনোজার পর চরম বুদ্ধিবাদীরূপে উল্লেখ করতে হয় লাইবনিজের নাম। তিনি বলেন, আমাদের সমস্ত প্রকার জ্ঞানের উৎস হল সহজাত ধারণা এবং তা কেবল বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমেই লাভ করা যায়। সুতরাং, এই সমস্ত বুদ্ধিবাদী দার্শনিককে চরমপন্থী বুদ্ধিবাদীরূপে অভিহিত করা হয়।
চরমপন্থী বুদ্ধিবাদের মূল্যায়ন
চরমপন্থী বুদ্ধিবাদের সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তিতর্কের অবকাশ থাকলেও এরূপ মতবাদ কখনোই পরিপূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, বুদ্ধিকেই যদি জ্ঞানের একমাত্র উৎসরূপে গণ্য করা হয়, তাহলে আমাদের সামনে প্রতীয়মান এই বিশাল অভিজ্ঞতার জগৎ একেবারেই মিথ্যারূপে গণ্য হয়। কিন্তু আমাদের সামনে প্রতীয়মান এই বিশাল অভিজ্ঞতার জগৎ কখনোই মিথ্যা হতে পারে না। এই প্রতীয়মান জগৎ থেকেই আমরা জ্ঞানের প্রয়োজনীয় উপাদান (matter) গ্রহণ করে থাকি, আর বুদ্ধি তার ওপর আকার (form) প্রদান করে। সুতরাং, শুধু বুদ্ধি দ্বারা সম্পূর্ণ জ্ঞান সম্ভব নয়, তার জন্য অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন।