ঐতিহাসিক টেইন, রুস্তান, সেতোব্রিয়াঁ, মাদেলা, জোরেস, মাতিয়ে প্রমুখ মনে করেন যে, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ফরাসি দার্শনিকগণ তাঁদের লেখনীর দ্বারা রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলি দেশের সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরেন। ফলে ফ্রান্সের শোষিত ও অবহেলিত মানুষের মনে বিপ্লবের বীজ রোপিত হয়।
|
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান আলোচনা করো। |
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা/অবদান
ফ্রান্সের জনগণের মনে বিপ্লবের বীজ রোপণে মন্তেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, ডেনিস দিদেরা, ডি' এলেমবার্ট প্রমুখ দার্শনিক এবং ফিজিওক্র্যাট নামে দার্শনিক গোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
[1] মন্তেস্কু: ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্ক (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রি.) ছিলেন দেশের বঞ্চিত শ্রেণির প্রাণপুরুষ। মন্তেস্ক তাঁর 'দ্য স্পিরিট অব লজ'বা 'আইনের মর্ম' নামক গ্রন্থে সম্রাটের স্বৈরাচারী শাসন ও স্বর্গীয় অধিকারতত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেন। 'দ্য পার্সিয়ান লেটার্স' বা 'পার্সিয়ার পত্রাবলি' নামে অপর একটি গ্রন্থে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক মন্তেস্কু ফ্রান্সের পুরাতনতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেন। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সমর্থক মন্তেস্ক মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে দেশের আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগকে পৃথক করার দাবি জানান।
[2] ভলতেয়ার: ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮ খ্রি.) ছিলেন ফ্রান্সের অন্যতম দার্শনিক, সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ। তিনি ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি তীক্ষ্ণ ব্যাঙ্গাত্মক রচনার মাধ্যমে ফরাসি গির্জার দুর্নীতি ও কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও অত্যাচারকে আক্রমণ করেন। তিনি ক্যাথোলিক গির্জাকে 'বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত উৎপার্ত' বলে অভিহিত করেন। তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল 'কাঁদিদ' (Candide) ও দার্শনিকের অভিধান' (Philosophical Dictionary)
[3] রুশো: অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় দার্শনিক ছিলেন জাঁ জ্যাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.)। তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ 'সামাজিক চুক্তি' (Social Contract)-তে রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা যুক্তি সহকারে খণ্ডন করেন। তিনি বলেন যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির উৎস হল জনগণ। কেননা, 'জনগণের ইচ্ছা' ('General Will') অনুসারেই একদিন চুক্তির দ্বারা রাজা শাসনক্ষমতা লাভ করেছিলেন। তাই রাজাকে যে-কোনো সময় ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার জনগণের আছে। তিনি তাঁর 'অসাম্যের সূত্রপাত' (Origin of Inequality) গ্রন্থে বলেন যে, মানুষ স্বাধীন হয়ে এবং সমান অধিকার নিয়ে জন্মায়। কিন্তু বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা তাকে দরিদ্র ও পরাধীন করে।
[4] ডেনিস দিদেরো ও ডি' এলেমবার্ট: ডেনিস দিদেরো, ডি' এলেমবার্ট প্রমুখ দার্শনিক রাষ্ট্র ও গির্জার অন্যায়ের কঠোর সমালোচনা করেন। তারা অসীম পরিশ্রম করে সতেরো খণ্ডে 'বিশ্বকোশ' রচনা করেন। এতে বিভিন্ন দার্শনিকের রচনা, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক প্রভৃতি বিষয় স্থান পায়।
[5] ফিজিওক্র্যাট গোষ্ঠী: অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে ফিজিওক্র্যাট নামে একটি অর্থনীতিবিদ গোষ্ঠী ফ্রান্সের বাণিজ্যে শুল্কনীতি ও নিয়ন্ত্রণ প্রথার তীব্র সামলোচনা করে এবং অবাধ বাণিজ্যনীতি ও বেসরকারি শিল্প স্থাপনের দাবি জানায়। এই মতবাদের অন্যতম সমর্থক ছিলেন কেনে।
মূল্যায়ন: ফ্রান্সে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে উপরোক্ত দার্শনিকদের অতি নগণ্য অবদান ছিল বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন। অবশ্য ঐতিহাসিক রাইকার, সেতোব্রিয়াঁ, টেইন, রুস্তান প্রমুখ ফরাসি বিপ্লবের জন্য দার্শনিকদের ভূমিকা স্বীকার করেছেন। টেইন বলেছেন যে, "ফ্রান্স দর্শনের বিষ পান করেছিল।"