ফ্রান্সের বিপ্লবী প্রজাতান্ত্রিক সরকার রাজা ষোড়শ লুই-এর প্রাণদণ্ড (২১ জানুয়ারি, ১৭৯৩ খ্রি.) দিলে রাজতন্ত্রের সমর্থকরা শীঘ্রই প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবিপ্লব শুরু করে। বিভিন্ন বিদেশি শক্তিও ফ্রান্সকে আক্রমণের উদ্যোগ নেয়। এই পরিস্থিতিতে জ্যাকোবিন দল ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন চালু করে।
ফ্রান্সের সন্ত্রাসের শাসন পরিচালনা
[1] সন্ত্রাসের সংগঠন: সন্ত্রাসের শাসনের সংগঠনেー[i] জননিরাপত্তা সমিতি, [ii] সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি, [iii] সন্দেহের আইন, [iv] বিপ্লবী বিচারালয় প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। জননিরাপত্তা সমিতি সন্ত্রাস পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করত, সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করত, সন্দেহের আইনের দ্বারা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হত, বিপ্লবী বিচারালয়ে তাদের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত এবং বিপ্লবের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে গিলোটিনে তাদের হত্যা করা হত।
[2] জ্যাকোবিন ও জিরন্ডিস্টদের বিরোধ: সন্ত্রাসের প্রথম পর্বে জ্যাকোবিন ও জিরন্ডিস্ট দল যৌথভাবে সন্ত্রাসের শাসন পরিচালনা করতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই উভয় দলের মধ্যে বিরোধ শুরু হয় এবং সন্ত্রাসের দ্বারা জ্যাকোবিনরা জিরন্ডিস্টদের দমিয়ে ফেলে। রোবসপিয়ার, হিবার্ট, দাঁতোঁ, কার্নো প্রমুখ সন্ত্রাস পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
[3] লাল সন্ত্রাস: কিছুদিনের মধ্য হিবার্ট, দাঁতোঁ প্রমুখ সন্ত্রাসের ভয়াবহতার প্রতিবাদ করলে রোবসপিয়ার তাঁর সতীর্থ হিবার্ট ও দাঁতোঁকে প্রাণদণ্ড দেন। রোবসপিয়ার ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের মধ্যভাগ থেকে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। তাঁর নেতৃত্বে পরবর্তী ৩ মাসে সন্ত্রাস ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এই পর্বে সংঘটিত সন্ত্রাস 'লাল সন্ত্রাস' নামে পরিচিত।
[4] সন্ত্রাসের ভয়াবহতা : সন্ত্রাসের দ্বারা অন্তত ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয় এবং বহু মানুষ চিরদিনের মতো নিখোঁজ হয়ে যান। প্রায় ৩ লক্ষ
মানুষকে সন্দেহের আইনের দ্বারা গ্রেফতার করা হয়। সন্ত্রাসের মাধ্যমে রানি মারি আঁতোয়ানেত, মাদাম রোলাঁ, ব্রিসো, বারনাভ, বেইলি, লাভয়েসিয়ে প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হয়।
[5] সন্ত্রাসের অবদান সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় ইউরোপের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় জ্যাকোবিন, জিরন্ডিস্ট ও মধ্যপন্থী দল আতঙ্কিত হয়ে রোবসপিয়ার ও তাঁর অনুগামীদের বন্দি করে (২৭ জুলাই, ১৭৯৪ খ্রি.)। ২৮ জুলাই জাতীয় সভার নির্দেশে রোবসপিয়ার ও তাঁর ২৪ জন অনুগামীকে গিলোটিনে হত্যা করা হলে সন্ত্রাসের শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
সুপ্তাঙ্গের শাসনের কৃতিত্ব বা সাফল্য
ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের বিভিন্ন কৃতিত্ব বা সাফল্য ছিল। যথা- [1]সন্ত্রাসের শাসনের ফলে ফ্রান্সের প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপ দমিত হয় এবং অরাজকতা ও গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। বিদেশি শক্তিগুলির আক্রমণের হাত থেকেও বিপ্লবী ফ্রান্স রক্ষা পায়। [2] গির্জাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রচলিত খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জি বাতিল করে 'প্রজাতান্ত্রিক বর্ষপঞ্জি' চালু করা হয়) বা নতুন মাপ, ওজন ও মুদ্রা ব্যবস্থায় দশমিক প্রথা চালু করা হয় । বিভিন্ন দ্রব্যের সর্বোচ্চ মূল্য ও মজুরির সর্বনিম্ন হার বেধে দেওয়া হয়। [6] অভিজাতদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা কৃষকদের মধ্যে বিলি করা হয়। [7] দোসপ্রথার অবসান ঘটানো হয়) (৪) খাবারের জন্য রেশন কার্ড চালু করা হয়) [9] ধর্মনিরপেক্ষ ও অবৈতনিক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়। [10] ১০ লক্ষ সেনার এক বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয় ৷[11] একটি প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করা হয়। অবশ্য এটি কার্যকর করা হয়নি।