জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত স্পিনোজার মতবাদ
প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক স্পিনোজা হলেন একজন বুদ্ধিবাদী দার্শনিক। তিনি বিশ্বাস করেন যে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই হল জ্ঞানের মৌল উৎস। অর্থাৎ, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমেই আমরা নিশ্চিত ও যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারি। তাঁর মতে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই এবং সেকারণেই তা জ্ঞানের মর্যাদালাভে সমর্থ নয়। যথার্থ জ্ঞান তাই কখনোই অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, অবশ্যই বুদ্ধিলব্ধ।
মূল উৎস হিসেবে 'সহজাত ধারণা':
দেকার্তের মতো স্পিনোজাও দাবি করেন যে, আমাদের যথার্থ ও নিশ্চিত জ্ঞানের মৌল উৎস হল সহজাত ধারণা এবং এই সহজাত ধারণাগুলি হল অবশ্যই বুদ্ধিলব্ধ। দেকার্ত অবশ্য এই সহজাত ধারণা ছাড়া আগন্তুক ও কৃত্রিম ধারণা নামক আরও দু-প্রকার ধারণাকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেই সমস্ত ধারণাপ্রসূত জ্ঞানকে তিনি অযথার্থ জ্ঞানরূপে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং দেখা যায় যে, দেকার্ত যথার্থ এবং অযথার্থ-এই দু-প্রকার জ্ঞানের উল্লেখ করেছেন। দেকার্তকে অনুসরণ করলেও স্পিনোজা কিন্তু তিনপ্রকার জ্ঞানের কথা বলেছেন। এই তিনপ্রকার জ্ঞান হল যথাক্রমে-[1] অসম্পূর্ণ জ্ঞান যা অযথার্থরূপে গ্রাহ্য, [2] সম্পূর্ণ জ্ঞান যা যথার্থ বৌদ্ধিক জ্ঞানরূপেই গণ্য এবং [3] স্বজ্ঞালব্ধ পরম জ্ঞান। প্রথম প্রকারের জ্ঞানের উৎস হল ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, কল্পনা প্রভৃতি। কিন্তু দ্বিতীয়প্রকার জ্ঞানের মৌল উৎস হল প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি। তাঁর মতে, এই ধরনের জ্ঞান হল যথার্থ ও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আর স্বজ্ঞালব্ধ পরম জ্ঞানের মৌল উৎস হল স্বজ্ঞা বা সাক্ষাৎ অনুভূতি (Intuition)। এই ধরনের জ্ঞানকে তিনি পরম জ্ঞানরূপে উল্লেখ করেছেন। কারণ, এই ধরনের জ্ঞান লাভ করার পর মানুষের আর অন্য কোনো কিছু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার থাকে না। এই স্বজ্ঞা বা সাক্ষাৎ অনুভূতিও হল বিশুদ্ধ বুদ্ধিপ্রসূত।
জ্যামিতিক পদ্ধতির প্রয়োগ:
স্পিনোজা তাঁর দর্শনতত্ত্বের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, তা জ্যামিতিক পদ্ধতি (geometrical method) নামে খ্যাত। দেকার্ত যেমন বুদ্ধিলব্ধ 'আমি' বা 'আত্মার' ধারণা ও তার অস্তিত্বের ওপর দর্শনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন, স্পিনোজাও তেমনই বুদ্ধিলব্ধ একমাত্র দ্রব্য তথা ঈশ্বরের সহজাত ধারণার ওপর ভিত্তি করে জ্যামিতিক পদ্ধতিতে সব কিছুকেই ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরই হলেন একমাত্র দ্রব্য। ঈশ্বর হলেন অসীম, অনন্ত, সর্বশক্তিমান ও স্বনির্ভর এবং স্বতঃজ্ঞাত সত্তা, যা থেকে জীবজগৎ বা প্রকৃতির উৎপত্তি ঘটেছে। তাই তিনি বলেন, দ্রব্য = ঈশ্বর = প্রকৃতি। এরকম বিষয়টিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হলে প্রয়োজন হয় বিশুদ্ধ বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার। সুতরাং, আমাদের বুদ্ধি তথা প্রজ্ঞার স্বচ্ছ আলোকে একমাত্র ঈশ্বরের জ্ঞানই লাভ করা যায় এবং এরূপ বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞানই হল একমাত্র যথার্থ জ্ঞান।