জ্ঞানের উৎপত্তি সংক্রান্ত দেকার্তের মতবাদ
বুদ্ধিবাদের মূল বক্তব্য এই যে, বুদ্ধিই হল জ্ঞানের মৌল উৎস। বুদ্ধিকে জ্ঞানের মূল উৎসরূপে স্বীকার করে নিলেও বুদ্ধিবাদী দার্শনিকরা দু- ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন- [1] চরমপন্থী ও [2] নরমপন্থী। চরমপন্থী
বুদ্ধিবাদের মূল বক্তব্য এই যে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস। এ ছাড়া জ্ঞানের আর দ্বিতীয় কোনো উৎস নেই। চরমপন্থী বুদ্ধিবাদের অন্যতম প্রবক্তা হলেন প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক রেঁনে দেকার্ত। রেঁনে দেকার্ত আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনকরূপেও গণ্য।
জ্ঞানের একমাত্র উৎস হিসেবে বুদ্ধি:
চরমপন্থী বুদ্ধিবাদী দার্শনিক দেকার্ত মনে করেন যে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস। কারণ, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার দ্বারা যে জ্ঞান পাওয়া যায় তা যথার্থ, সুনিশ্চিত, অনিবার্য ও সর্বজনীনরূপে গণ্য। দেকার্তের মতে, ইন্দ্রিয় সংবেদনের দ্বারা কখনোই সার্বিক জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। বিশুদ্ধ বুদ্ধিই কেবল আমাদের সার্বিক জ্ঞান প্রদান করতে পারে।
আদর্শ জ্ঞান হিসেবে গাণিতিক জ্ঞান:
দেকার্ত জ্ঞানের মাপকাঠি হিসেবে স্পষ্টতা, স্বচ্ছতা ও প্রাঞ্জলতার কথা উল্লেখ করেন। অর্থাৎ, তাঁর মতে, জ্ঞানরূপে কোনো বিষয়কে গণ্য হতে গেলে, তাকে স্পষ্ট, স্বচ্ছ ও প্রাঞ্জলরূপে গণ্য হতে হবে। আর এই ধরনের জ্ঞান কখনোই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় লাভ করা যায় না। কেবল বিশুদ্ধ বুদ্ধিই এই ধরনের জ্ঞান প্রদান করতে পারে। তাঁর মতে, গণিতের জ্ঞানই হল এরূপ আদর্শ জ্ঞান। কারণ, গণিতের জ্ঞানগুলি সংশয়াতীত এবং এগুলি স্পষ্ট, স্বচ্ছ ও প্রাঞ্জলরূপে গণ্য। গণিতের সুনিশ্চিত জ্ঞানের মতো দর্শনেও সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভের আশায় দেকার্ত দর্শনতত্ত্বের ক্ষেত্রে গাণিতিক পদ্ধতির অনুসরণ করেন।
অবরোহ পদ্ধতির সাহায্যগ্রহণ:
দেকার্তের মতে, গণিতের ক্ষেত্রে কয়েকটি স্বতঃসিদ্ধ সূত্রের ওপর নির্ভর করে অবরোহ পদ্ধতির সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলি অবশ্যই সুনিশ্চিত ও সার্বিকরূপে গণ্য। তিনি তাই দাবি করেন যে, দর্শনের ক্ষেত্রেও যদি বুদ্ধিলব্ধ স্বতঃসিদ্ধ সহজাত ধারণার ওপর ভিত্তি করে অবরোহ পদ্ধতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তাহলে তাও নিশ্চিত ও সার্বিকরূপে গ্রাহ্য হবে। আর দর্শনের ক্ষেত্রে গাণিতিক ও অবরোহাত্মক পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হলে, অবশ্যই বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে, কখনোই ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ওপর নয়।
সংশয় পদ্ধতির অনুসরণ:
দর্শনের ক্ষেত্রে সুনিশ্চিত ও স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞানলাভের জন্য দেকার্ত আরও একটি পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন এবং তা হল সার্বিক সংশয় পদ্ধতি (The Method of Doubt)। এরূপ পদ্ধতি অনুসারে যথার্থ, সুনিশ্চিত ও সার্বিক জ্ঞানলাভের আশায় প্রচলিত সমস্ত জ্ঞানকেই সংশয় বা সন্দেহ করতে হয়। এরূপ সংশয় বা সন্দেহ করার মাধ্যমে তিনি এই সত্য অনুভব করেন যে, সমস্ত কিছুকে সংশয় করা গেলেও, সংশয়কে আর সন্দেহ করা যায় না। অর্থাৎ, সংশয় যে আছে, তা প্রমাণিত। আর সংশয় থাকলেই সংশয়কর্তাও থাকবে এবং সেটাই হল নিশ্চিত জ্ঞান। এভাবেই তিনি তাঁর সংশয়াতীত যে সত্যমূলক বাক্যে উপনীত হয়েছেন, তা হল-'আমি চিন্তা করি, অতএব আমি আছি' (I think, therefore I am.)। দেকার্তের দর্শনে এটিই হল বুদ্ধিলব্ধ প্রথম স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান।